চামড়ার সেই দাম নেই, ঝামেলাও নেই

কয়েক বছর আগেও একটি কোরবানির গরুর চামড়া ২০০০-২২০০ টাকা এমনকি ৩ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যেত, সেই চামড়া এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2020, 03:00 PM
Updated : 1 August 2020, 03:10 PM

চামড়ার এই দাম কমায় এবার চট্টগ্রামে অদৃশ্য হয়ে গেছেন কোরবানিকেন্দ্রিক মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা। এই সুযোগে চামড়ার আড়তদারদের প্রতিনিধিরাই বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া কিনছেন নিজেদের সুবিধামতো দামে। সেই চামড়া আড়তে পৌঁছে কিছু মুনাফা করছেন তারা।

সে কারণে এবার চামড়া নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না বলেই মনে করছেন চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা। গেল বছর সারা দেশে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া কিনে আড়তে বা তাদের প্রতিনিধিদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে দাম না পেয়ে ক্ষোভে রাস্তায় ফেলে যান অনেকে।

এবার তাদের জায়গায় নিজেদের প্রতিনিধিরাই চামড়া সংগ্রহ করছেন জানিয়ে চট্টগ্রামের আড়তদাররা বলছেন, মুরাদপুরের আতুড়ার ডিপো এলাকায় বিভিন্ন আড়তে দুপুরের পর থেকেই চামড়া আসতে শুরু করেছে। রাতের মধ্যেই তাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি চামড়া চলে আসবে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া সংগ্রহ করে চৌমুহনী এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আড়তদারের প্রতিনিধিরা চামড়া সংগ্রহ করে মুরাদপুর এলাকায় আড়তে পাঠিয়ে দেন।

চামড়ার দাম কম হওয়ায় এবার মাঠে নেই মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা, নিজেদের যুতসই দামে চামড়া কিনে নিচ্ছেন আড়তদারদের প্রতিনিধিরা। ছবি: সুমন বাবু

চৌমুহনী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আগে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা সেখানে চামড়া বিক্রির জন্য গেলেও এবার নেই। আড়তদারদের স্থানীয় প্রতিনিধিরাই চামড়া সংগ্রহ করছেন।

চৌমুহনীতে মো. আলম নামে এক আড়তদার প্রতিনিধি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দরে তারা চামড়া কিনে নিচ্ছেন। সেখান থেকে কিছু লাভে সেগুলো আড়তে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, “আগের বছরগুলোতে বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া নিয়ে এখানে আসত। আর আমরা তাদের কাছ থেকে কিনে নিতাম। এবার সে সংখ্যা কম। গতবছর অনেকেই চামড়া কিনে যে ক্ষতিতে পড়েছিলেন তা পুষিয়ে উঠতে পারেননি। যার কারণে এ বছর অনেকই চামড়ার মৌসুমী ব্যবসা করছেন না।

“গত বছর ৭০০ টাকা চামড়ার দরদাম করেও অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী চামড়া বিক্রি করেননি আমাদের কাছে। পরে ক্রেতা না পেয়ে চামড়াগুলো নষ্ট হয়েছে। রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যেতে হয়েছিল।”

গতবছর কোরবানির ঈদে চামড়ার ‘নায্য মূল্য’ না পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় ও আবর্জনার ভাগাড়ে চামড়া ফেলে গিয়েছিলেন ফড়িয়ারা। তাতে তৈরি হয় নজিরবিহীন সঙ্কট।

এবছর আড়তদাররা কোরবানির ঈদের আগেই দাম বুঝে চামড়া সংগ্রহ করতে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

গত ২৬ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। তাতে ঢাকা থেকে প্রতি বর্গফুট চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা হিসাবে লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহ করতে বলা হয়। এ বছর এটাই সর্বনিম্ন দাম বলে জানিয়েছেন এই ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা।

চামড়া ব্যবসায়ীদের ভাষ্য মতে, একটি গরুর চামড়া সর্বনিম্ন ১৬ থেকে ৩০ থেকে ৩২ বর্গফুটের মতো হয়ে থাকে।

সে হিসাবে সরকার নির্ধারিত দামে একটি বড় গরুর চামড়ার দাম ৯০০ টাকার উপরে আসে। সেখানে চামড়াগুলো কেনা হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।

চৌমুহনী এলাকায় চামড়া নিয়ে অবস্থান করা মো. নাঈম নামে একজন জানান, তিনি আকারভেদে ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় চামড়া সংগ্রহ করছেন। সেগুলো সামান্য কিছু বেশি দামে আড়তদাররা নিয়ে নেবেন তার কাছ থেকে।

আড়তদারদের প্রতিনিধি হয়ে চৌমুহনীতে অবস্থান করা একাধিক ব্যক্তি জানান, এ বছর চামড়ার দাম কম হওয়ায় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা আসতে পারেনি। বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের সাথে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। শুধু তারাই চামড়া সংগ্রহ করে চৌমুহনীতে নিয়ে আসছেন।

কোরবানি শেষে শনিবার বিকেলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় পশুর চামড়া সংগ্রহের ব্যস্ত কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের প্রতিনিধিরা। ছবি: সুমন বাবু

চামড়ার দাম নিয়ে আড়তদারের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করা মনুলাল বড়ুয়া নামে একজন বলেন, “এমন বছরও গেছে যখন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। সে দাম এখন নেমে এসেছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।”

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচাচামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির আহ্বায়ক মাহবুব আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে শহরের বাইরে থেকেও অনেকে কাঁচা চামড়া নিয়ে আসতেন। এবার তাদের আমরা এখানে আসতে নিষেধ করেছি।

“শহরের বাইরে যারা চামড়া বেচাকেনা করেন তাদের লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখতে বলা হয়েছে। কাল পরশু তারা চামড়াগুলো আড়তে নিয়ে যাবেন। তবে এ বছর চামড়ার কোনো সংকট হবে না।”

চট্টগ্রাম কাঁচাচামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন স্থান থেকে আড়তে চামড়া আসা শুরু করেছে। রাতের মধ্যেই প্রায় চামড়া চলে আসবে। ফলে এবার চামড়ার সঙ্কট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

তিনি বলেন, “গতবছর ফড়িয়াদের কারণে চামড়ার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল। তারা বাজার না বুঝে বেশি দামে চামড়া সংগ্রহ করে দাম ধরে রেখেছিল। যার কারণে অনেকেই চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিয়েছিলেন।

“এ বছর গরমের সময়ে কোরবানির ঈদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার কারণে সংগ্রহ করা চামড়া লবণ ছাড়া বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। সে জন্য দূরদূরান্তে যারা আছেন তাদের বলেছি লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করতে। পরে সেগুলো আমাদের আড়তে নিয়ে আসবেন।”

গরুর চামড়া কিনে নিলেও ছাগলের চামড়া কেউ কিনছেন না। চৌমুহনী এলাকায় গরুর চামড়ার পাশে ছাগলের চামড়া রাখা হলেও সেগুলোর জন্য তারা কোনো দাম পরিশোধ করেনি।

চৌমুহনীতে আড়তদারদের প্রতিনিধিরা জানান, তারা ছাগলের চামড়া কিনছেন না। অনেকেই গরুর সাথে ছাগলের চামড়া নিয়ে এসে সেটি রেখে যাচ্ছেন।