প্রতিমার কাজ নেই, কষ্টে মৃৎশিল্পীরা 

মণ্ডপে পৌঁছায়নি এমন কয়েকটি প্রতিমা আছে কারখানা প্রাঙ্গণে। অন্য বছর এ সময়ে দুর্গাপূজার বায়না আসতে শুরু করলেও এবার তার খবর নেই। ফলে নেই প্রতিমা গড়ার ব্যস্ততা।

চট্টগ্রাম ব্যুরোউত্তম সেনগুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2020, 05:03 AM
Updated : 12 July 2020, 08:25 AM

আর প্রতিমাই যদি না গড়া যায়, তাহলে এর শিল্পীরা ভালো থাকেন কী করে? করোনাভাইরাস মহামারী তাদের সব ব্যস্ততা থামিয়ে দিয়েছে। আয়-রোজগার বন্ধ হওয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা শঙ্কায় তারা।  

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজার আয়োজন হয় বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে। সে হিসেবে মৃৎশিল্পীরাও তাদের কাজের হিসাব করেন বাংলা বছর অনুযায়ী।

বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে থেকে মূলত পূজাভিত্তিক প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেন শিল্পীরা। অন্যান্য বছর এই সময়ে ব্যস্ত থাকলেও তারা এখন অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন। এমন সময়ে ভাড়া করে করিগর আনতে হয়, অথচ এবার কারখানাগুলো এখনও ফাঁকা।

চট্টগ্রামে বংশানুক্রমিকভাবে যারা প্রতিমা তৈরি করেন তাদের বেশিরভাগের আদি নিবাস বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে। সেখান থেকে এসে তারা চট্টগ্রামে স্থায়ী হয়েছেন। একইভাবে প্রতিমা তৈরির কারখানায় যারা কাজ কনে তাদেরও বেশিরভাগ শরীয়তপুর, নেত্রকোণা, ফরিদপুর এলাকার। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর সাথে সাথেই তারা চলে গেছেন নিজ নিজ এলাকায়।

মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের থাবা বিস্তার শুরু হওয়ার পর পণ্ড হয়েছে বাসন্তী পূজার আয়োজন। সেই প্রতিমার কার্যাদেশ দিয়েও বাতিল করেছিল আয়োজকরা। কয়েক মাস পর দুর্গাপূজার আয়োজন নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন সবাই। অথচ প্রতিমাশিল্পীদের আয়ের সিংহভাগই আসে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করেই।

চট্টগ্রামের মৃৎশিল্পীদের সংগঠন ‘চট্টগ্রাম মৃৎশিল্পী সমিতির’ সভাপতি রতন পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্গাপূজার আড়ম্বর আয়োজন হবে কী হবে না, সেজন্য আমাদের সরকার ও পূজা কমিটির নির্দেশনা দরকার।

“দুর্গাপূজার কাজ দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। অনেকেই তিন থেকে পাঁচ মাস ধরেও কাজ করে। তবে এবার আমরা উভয় সংকটে আছি। কাজ শুরু করব কী করব না… যদি এক মাস আগে বলা হয় পূজা হবে তাহলে আমরা প্রতিমার কাজ নিয়ে আয়োজকদের বুঝিয়ে দিতে পারব না।”

রতন বলেন, এখন বছরজুড়েই কাজ থাকে। তবে এবার ব্যতিক্রম। পূজার কোনো সুযোগ নেই।

“বাসন্তী পূজা হল না। তারপর চার মাস কোনো কাজ নেই। দিন চালানোর জন্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল তাও শেষের পথে। দুর্গাপূজার প্রতিমার জন্য যদি বিনিয়োগ করে পূজা না হয় তাহলে আমাদের কী হবে,” প্রশ্ন রতনের।

চট্টগ্রামের মৃৎশিল্পীরা জানিয়েছেন, আশ্বিনে দুর্গাপূজা হলেও বৈশাখ থেকে শুরু হয় তাদের কাজ। শ্রাবণ মাসে মনসা পূজা, তারপর থেকে গনেশ, বিশ্বকর্মা, দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী ও জগদ্বাত্রী পূজা, রাস পূর্ণিমা ও কার্ত্তিক পূজার আয়োজন চলে কার্তিক মাস পর্যন্ত। ফাল্গুনে স্বরস্বতী, চৈত্রে অনুষ্ঠিত হয় বাসন্তী পূজা।

সারাবছরই পূজা ভিত্তিক প্রতিমা তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিমা ও মূর্তি তৈরির কাজ করে থাকেন মৃৎ শিল্পীরা। তবে তাদের মূল রোজগার হয় দুর্গা পূজায়।

চট্টগ্রামের সরদঘাট এলাকায় প্রতিমা তৈরির কাজ করেন সুজন পাল। তাদের পারিবারিক কারখানায় অন্তত ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন।

সুজন পাল জানান, গত বাসন্তী পূজায় নয়টা প্রতিমা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস ঠেকাতে লকডডাউন শুরু হয়ে যাওয়ায় সব কাজ বাতিল হয়ে যায়।

“যারা বাসন্তী প্রতিমা তৈরি করতে দিয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ অল্প টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। আবার পরিচিত অনেকে অগ্রিমও দেয়নি। প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার সময় টাকা পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু অনাড়ম্বর পূজা হওয়ায় তারা কেউ প্রতিমা নেয়নি। যার কারণে আমাদের ক্ষতি হয়েছে অনেক।

“আয় রোজগারের মূল কাজটি হয় এই সময়ে। কারখানায় দম ফেলার ফুরসত থাকে না। তবে এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্যান্য বছর এই সময়ে অনেকে প্রতিমা তৈরির অর্ডার দিয়ে দেন। তবে এবছর এখনও কোনো প্রতিমা তৈরির কাজ পাইনি। খুব অন্ধকার দেখছি ভবিষ্যতের জন্য। কী হবে কিছুই বুঝতে পারছি না।”

সুজন বলেন, “এই সময়ে আমাদের কারখানায় অনেক কারিগর কাজ করেন। এবার আছে মাত্র একজন। দুর্গাপূজা হবে কিনা তারও কোনো নির্দেশনা পাইনি। এ অবস্থায় তাদের বাড়ি থেকে এসে কাজে যোগ দিতেও বলতে পারছি না। তাছাড়াও আছি আতঙ্কে। যদি পূজার আয়োজন না হয়, তাহলে এতগুলো শ্রমিককে চট্টগ্রামে এনে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেব। পাশাপাশি নিজেরও বড় আর্থিক ক্ষতির ভয় তো আছেই।

“পূজাভিত্তিক প্রতিমা তৈরি ছাড়াও ঘরোয়াভাবে পূজার জন্য কিছু প্রতিমা তৈরি করি আমরা। কিন্তু এবছর সে ধরনের প্রতিমা নেয়ারও লোক নেই। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো না।”

সুজনের মতো একই সুরে কথা বললেন চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ মৃৎশিল্পী অমল পালও।

তিনি জানান, এবারের বাসন্তী পূজায় তিনি অর্ডার পেয়েছিলেন ১৭টি প্রতিমা তৈরির। তার মধ্যে ঘরোয়া পূজার দুইটি প্রতিমা বিক্রি করেছেন। বাকিগুলোর অর্ডার বাতিল হয়েছে।

“বাসন্তী প্রতিমা তৈরি করে অনেক টাকা গচ্চা দিয়েছি। পরিস্থিতি ভালো হবে মনে করে তিন মাসে চার লাখ টাকার মতো কারিগরের বেতন দিয়েছি বিনা কাজে। পরে বাধ্য হয়ে তাদের বাড়ি চলে যেতে বলেছি।

“আমাদের কাজ না থাকলে কারিগররা খাবে কী? তারা বিভিন্ন সময়ে টাকার জন্য ফোন করে। কাজ নাই তবুও তাদের বিভিন্নভাবে টাকা দিয়ে সহায়তা করতে হয়।”

অন্যান্য বছর এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৫০টির মতো দুর্গা প্রতিমা তৈরির অর্ডায় পান অমল পাল। এবছর একটা পাননি।

“এসময় আমাদের ইনকামের সময়। কিন্তু কোনো কাজ নেই। রেডিমেইড কিছু প্রতিমা তৈরি করেছি। সেগুলোর বিক্রিও কম।”