মহামারীতেও চট্টগ্রামে নিয়মিত খুনোখুনি, এক মাসে ঝরেছে ২০ প্রাণ

নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও চট্টগ্রামে থেমে নেই খুনোখুনি। তুচ্ছ ঘটনা, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা কারণে খুনখারাবি লেগেই আছে।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2020, 11:25 AM
Updated : 3 July 2020, 11:15 AM

পুলিশের তথ্য এবং গণমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী, চট্টগ্রামে গত এক মাসে খুন হয়েছেন অন্তত ২০ জন, যাদের মধ্যে পাঁচজন পারিবারিক বিরোধের শিকার। পাশাপাশি সামাজিক বিরোধেও প্রাণ গেছে কয়েকজনের।

সামজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সামাজিক সঙ্গতি ও পারিবারিক বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। মহামারীর কারণে ‘লকডাউন’ দীর্ঘ হলে তখন মানুষের আয় রোজগারের পথ আরও রুদ্ধ হয়ে যাবে। ফলে পারিবারিক সহিংসতাও বাড়তে পারে বলে মত তাদের।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যটা বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক সঙ্গতি। মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে হিংস্রতা। এই কারণে মানুষ মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করছে না ইদানিং।”

তুচ্ছ ঘটনা, সামাজিক-পারিবারিক বিরোধে যত খুন

গত ১২ মে একদিনেই দুজন খুন জন দক্ষিণের উপকূলীয় বাঁশখালী উপজেলায়। দুই পরিবার ও ‘সমাজের বিরোধে’ এই খুনোখুনির ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানায়।

বাঁশাখালী থানার ওসি রেজাউল করিম মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামে সমাজপতিদের বিরোধ বংশানুক্রমিকভাবে অন্তত অর্ধশতাব্দী ধরে চলে আসছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে চলা এই বিরোধের বলি হন মো. খালেদ (২৫) নামের এক যুবক। গুলিবিদ্ধ হন ইব্রাহীম নামের আরেক যবিক, যিনি পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

একইভাবে উপজেলার দক্ষিণ সাধনপুর গ্রামে দুই পরিবারের বিরোধের জেরে খুন হয়েছেন ফজলুর রহমান নামে ৩৭ বছর বয়েসী এক ব্যক্তি। 

ইলশার জোড়া খুনের পর পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় নুরুল আনসার কালু নামে একজন।

এরপর ১৫ মে রাতে বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপে যাকাত বিতরণকে কেন্দ্র করে নিহত হন নাসের নামে এক যুবক। আহত হয় তার ৭৫ বছর বয়েসী মুক্তিযোদ্ধা বাবা।

বোয়ালখালীর সেই খুনের ঘটনায়ও গ্রেপ্তার একজনকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন শওকত হোসেন নামে একজন।

গত ১ মে দুপুরে ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুর বাজারে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া নিয়ে ছুরিকাঘাতে খুন হন স্থানীয় একটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নুরুল হক সায়মন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন মারা যান।

২৩ এপ্রিল রাতে সীতাকুণ্ড উপজেলায় সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া নিয়ে কিশোরদের বিরোধে খুন হয় দুই যুবক। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কয়েকজন কিশোরকে।

২৭ এপ্রিল একই উপজেলার সুয়াবিল এলাকায় বালুর মহাল নিয়ে বিরোধের জেরে দুইপক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন মো. আলাউদ্দিন (৪০) নামের এক ব্যক্তি।

এদিকে কর্ণফুলী থানা এলাকায় খুইদ্দ্যার টেক এলাকায় পারিবারিক শালিসে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় স্থানীয় একই পরিবারের বাবা ও তার দুই ছেলেসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। 

এই এলাকায় ১৯ এপ্রিল এক কবিরাজকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয়। এই ঘটনায় দুই সহোদরসহ ছয় তরুণকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানিয়েছে এক তরুণীর সাথে প্রেম ছিল হত্যাকান্ডে জড়িত মহিউদ্দিন নামে এক যুবকের। প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করতে তরুণীর মা কবিরাজের কাছে গিয়েছিলেন ঝাড়ফুঁকের জন্য।

মেয়েটি পালিয়ে এসে ওই যুবককে বিয়ে করে এবং কবিরাজের বিষয়টি জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মহিউদ্দিন তার বন্ধুদের নিয়ে কবিরাজকে ‘শিক্ষা’ দেয়ার নামে পিটুনি দিলে মারা যান ৪০ বছর বয়েসী কবিরাজ শাহের মোহাম্মদ।

এদিকে ২ মে সকালে নগরীর ইপজেড থানার নিউমুরিং এলাকার এক ভবনের সিঁড়ি থেকে আনুমানিক ২৪ বছর বয়েসী এক হকারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। যাকে মুখে কাপড় গুঁজে ও টেপ লাগিয়ে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয় বলে ধারণা পুলিশের।  

তার আগে গত ২১ এপ্রিল পটিয়া উপজেলার কালারপোল এলাকায় একটি চায়ের দোকানের ড্রাম থেকে উদ্ধার করা হয় পান দোকানীর লাশ।

পান দোকানীর কাছে সাড়ে তিন লাখ টাকা আছে এমন তথ্যে তা হাতিয়ে নেয়ার জন্য এই খুন করা হয় বলে গ্রেপ্তার একজন স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন।

২৬ এপ্রিল রাউজানের পশ্চিম গহিরা অঙ্কুরিঘোনা এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বিতান বড়ুয়াকে।

২৬ এপ্রিল এই ফটিকছড়ি উপজেলার দক্ষিণ পাইন্দং ইউনিয়নেই পারিবারিক বিরোধ চাচীর হাতে খুন হয় চার বছর বয়েসী এক শিশু। 

গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানার সুপারিওয়ালা পাড়ায় পারিবারিক বিরোধের জেরে ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই খুন হয়। ২২ এপ্রিল পারিবারিক বিরোধের জেরে বাকলিয়া বড় কবরস্থান এলাকায় স্ত্রীকে শীল দিয়ে আঘাত করে খুন করে স্বামী।

পরদিন স্বামী মুছাকে গ্রেপ্তারের পর সে পুলিশকে জানায় একটি হত্যা মামলায় প্রায় ১০ বছর পর কারগার থেকে জামিনে বের হয় তিনি। আর্থিক অনটন নিয়ে বিভিন্ন বিরোধের জেরে স্ত্রীকে খুন করে পালিয়ে যায় মুছা।

৯ মে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার মুরাদ নগর এলাকায় পাওনা টাকা নিয়ে এক জনকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়।

এদিকে গত ১৬ মে পটিয়া উপজেলার ছনহরা ইউনিয়নে ইফতারের সময় ঠান্ডা পানি না পেয়ে জগ দিয়ে ঘাড়ের নিচে স্ত্রীকে আঘাত করে কামাল উদ্দিন নামে এক যুবক। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

পারিবারিক সহিংসতার বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, “ইদানিং সময়ে পারিবারিক বন্ধনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নানা কারণে তৈরি হচ্ছে বিরোধ। এসব কারণে খুনের মতো ঘটনাও ঘটছে।

“লকডাউনের আগেও পারিবারিক সামাজিক বিরোধে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। তবে এই লকডাউনে অনেকের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। এতেও মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়তে পারে।”

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক  বলেন, “চট্টগ্রামে বিগত কয়েকদিনে যতগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর বেশিরভাগই ‘ডমেস্টিক মার্ডার’। এই ধরনের অপরাধগুলো কখনও বাড়ে আবার কখনও কমে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও এই ধরনের ঘটনা ঘটছে।

“তবে পুলিশ কিন্তু বসে নেই। চট্টগ্রামে যতগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার প্রত্যেকটিরই রহস্য উদঘাটন করা হচ্ছে,  অপরাধীরাও ধরা পড়ছে।”