অনেক আশার রোজায় এবার ‘দিশেহারা’ ফুটপাতের হকাররা

সারা বছর উচ্ছেদ আতঙ্কের মধ্য দিয়ে কাটানো ফুটপাতের হকাররা অনেক প্রত্যাশা নিয়ে চেয়ে থাকেন রোজার মাসটির দিকে, ঈদ সামনে রেখে মানুষের সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা হয় যে এই মাসেই।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2020, 11:53 AM
Updated : 25 April 2020, 11:57 AM

এই এক মাসের আয় বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি হওয়ায় তা দিয়ে ধার-দেনাও পরিশোধ করেন তারা। সারা বছর চলার রসদেরও কিছুটা জমিয়ে নেওয়া হয় জমজমাট বেচাকেনার এই সময়।

তবে এবার করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সেই ব্যবসা তো দূরে থাক এখন পরিবারের পেট চালিয়ে নেওয়ায় বড় কষ্টের হয়ে পড়েছে বলে জানালেন হকাররা।

বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেওয়া নতুন করোনাভাইরাস অতি সংক্রামক, এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে মাসখানেক ধরে দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। অর্থাৎ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ রয়েছে বাইরের সব কাজকর্ম ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানও।

এই পরিস্থিতিতে রাস্তার পাশে জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসা তো দূরের কথা, শহরই ছেড়ে গেছেন হকারদের একটি বড় অংশ। আর যারা শহরে আছেন তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় বলে জানালেন কয়েকজন।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতের হকারদের তিনটি সংগঠনের হিসেব মতে, নগরীতে তাদের তালিকাভুক্ত প্রায় ২৫ হাজার হকার রয়েছে। এর বাইরে ভাসমান হকার রয়েছে সমান সংখ্যক, আবার ঈদ-পূজার আগের বিশেষ সময়গুলোতে মৌসুমী হকারদের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়।

হকাররা চরম দুর্দশায় পড়েছেন জানিয়ে চট্টগ্রাম হকার্স লীগের সভাপতি প্রবীণ কুমার ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হকাররা ভালো নেই। সারা বছর থাকে উচ্ছেদ আতঙ্ক। যে মাসটিতে তাদের ব্যবসা করার কথা সে মাসটিতেই তারা এখন বেকার হয়ে বাড়িতে বসে আছে।

“এছাড়া তাদের জন্য কোনো ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়নি। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু হকারদের ত্রাণের ব্যবস্থা করে দিলেও বেশিরভাগ সদস্যই ত্রাণ পায়নি। সব মিলিয়ে হকাররাই এখন করুণ পরিস্থিতিতে।”

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে মানুষের চলাচল সীমিত করতে সোমবার নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া মোড়ে যানবাহনে তল্লাশি চালায় জেলা পুলিশ।

চট্টগ্রাম নগরীর জুবলি রোড, স্টেশন রোড, কোতোয়ালী মোড়, আন্দরকিল্লা এলাকা ঘিরে ব্যবসা করেন অন্তত কয়েক হাজার হকার। এর বাইরে আগ্রাবাদ, ষোলশহর, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, ইপিজেড এলাকায়ও বিপুল সংখ্যক হকার ফুটপাতে ব্যবসা করে থাকেন।

নগরীর জুবলি রোডের আমতল এলাকায় গেঞ্জি-মোজার ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সারা বছর তারা ব্যবসা করলেও ঈদ সামনে রেখে তাদের ব্যবসা বেশি হয়। রোজার মাসেই থাকে জমজমাট বেচাবিক্রি।

“গত এক মাস ধরে আমাদের ব্যবসা বন্ধ। আজ থেকে শুরু হয়েছে রমজান। যে সময়ে আমাদের চট্টগ্রামে ব্যস্ত সময় পার করার কথা ছিল সে সময়টিতে নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছি। হাতে যে কয় টাকা ছিল এক মাসে তাও শেষ।”  

ইসমাইলের সুরে কথা বললেন জহুর হকার্স মার্কেট সংলগ্ন ফুটপাতের শার্ট ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন।

“আমরা দিশেহারা হয়ে গেছি। খুব কষ্টে জীবন চলছে। সারা বছর যে মাসটির জন্য অপেক্ষায় থাকি সে মাসটিতেই আমরা ঘরে বেকার সময় কাটাচ্ছি। দোকান করতে পারলে টাকা আসে হাতে। সে টাকায় সংসার চলে। গত এক মাসে তো দোকানই খুলতে পারি নাই। কীভাবে সংসার চলছে তা বলে বোঝানো যাবে না।”

বেলাল জানান, বছর দশেক আগে নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামে এসে নিজে প্রথম ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করলেও ধীরে ধীরে ভাই ও চার স্বজনকে নিয়ে আসেন চট্টগ্রামে। সবাই এখন ফুটপাতে ব্যবসা করেন।

“এই রমাজান মাসে রাত জেগে ব্যবসা হয় আমাদের। শীতের সময় এক মাস আর রোজায় যা রোজগার হয় তাই মূলত সারা বছরের ব্যবসার আয়। বাকিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি ঢাকা থেকেও মালামাল সংগ্রহ করি। বিভিন্ন সময়ে অল্প অল্প টাকা দিয়ে মালামাল সংগ্রহ করি। তবে ঈদের পর সব টাকা পরিশোধ করে নতুন করে ব্যবসার হিসেব শুরু হয়। কিন্তু লকডাউনে এবার মাথায় হাত!”

ইসমাইল, বেলালের মতো অসহায় অবস্থা স্টেশন রোডের টং দোকানি আরিফের।

তিনি জানান, রাস্তার পাশে টং দোকানে চা বিক্রি করে যা আয় হয় সেটা দিয়ে সংসার চলে। গত এক মাস দোকান খুলতে দেয়নি পুলিশ। ফলে বাসায় বেকার সময় পার হচ্ছে।

“রোজার মাসে পর্দা টাঙিয়ে চা আর রাতের বেলায় ভাত বিক্রি করলে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে বেশি আয় রোজগার হয়। কিন্তু এবার সব শেষ।”

স্বাভাবিক অবস্থায় মিরপুর ২ নম্বরের এই ফ্যাশন হাউজগুলোতে থাকে উপচেপড়া ভিড়। করোনাভাইরাসের কারণে বৈশাখ উৎসব বাতিল ও মার্কেট বন্ধ থাকায় এখন সেখানে কেবল সুনসান নিরবতা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

জুতার জন্য চট্টগ্রামের সব শ্রেণির মানুষের পছন্দের জায়গা আগ্রাবাদের ব্যাংক পাড়া। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর থেকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত ফুটপাতে চলে জুতা বিক্রি। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের জুতা মেলে আগ্রাবাদে।

ফুটপাতের জুতা বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন জানান, সারা বছর যে পরিমাণ জুতা বিক্রি হয় তার কয়েক গুণ বেশি বিক্রি হয় রোজার সময়।

“রোজার মাসটিতে আমাদের দম ফেলার সময় থাকে না। এবার বেকার সময় পার করছি বাসায়।”

এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, “ঢাকা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে জুতা সংগ্রহ করে আমরা বিক্রি করি। অনেক বকেয়া পরিশোধ করি রোজার মাসের বিক্রির আয় দিয়ে। এবার আয় তো দূরের কথা বকেয়াও পরিশোধ করা যাবে না।” 

চট্টগ্রাম সম্মিলিত হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি মীরণ হোসেন মিলন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, চট্টগ্রাম নগরীতে সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত হকার আছে নয় হাজার ৮৯৯ জন। আর তার বাইরে আছে আরও অন্তত ১৫ হাজার হকার। পাশাপাশি কিছু রয়েছে ভাসমান হকার, যারা বিভিন্ন রাস্তায় কিংবা পাড়া-মহল্লায় গিয়ে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করেন।

“আগে রাস্তায় দিনের বেলায় ব্যবসা করা গেলেও সম্প্রতি বিকাল ৫টা থেকে বসার অনুমতি দেয় প্রশাসন। এতে করে এমনিতেই হকারদের বেচা-বিক্রি কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে রোজার মাসে বসে থাকতে হচ্ছে।”

তিনি বলেন, শহরের লোকজনের পাশাপাশি গ্রাম থেকেও অনেকেই আসেন ঈদের বাজার করতে। এই মাসে রাত জেগেও অনেকে বিক্রি করেন। রোজার মাসে চট্টগ্রামের ফুটপাতে ‘কোটি টাকার’ বেচা বিক্রি হয়।

“লকডাউনে গত এক মাস ধরে রাস্তায় কোনো হকার নেই। তারা দোকান খুলতে পারলে রোজগার, বন্ধ থাকলে শূন্য হাত। সরকার সব সেক্টরে প্রণোদনা দিয়েছে, কিন্তু গরিব হকারদের জন্য কিছুই নাই। এমনকি তাদের জন্য সরকারি ত্রাণের ব্যবস্থাও করা হয়নি। সিটি মেয়রের পক্ষ থেকে কিছু ত্রাণ পাওয়া গেলেও তা অপ্রতুল।”

হকারদের যারা বাড়িতে যেতে পেরেছেন তারা কোনোভাবে চলতে পারলেও যারা যেতে না পেরে শহরে অবস্থান করছেন, তাদের অনেকেই ‘খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন’ বলে জানান তিনি।  

ফুটপাতে হকারদের জন্যও সরকারি প্রণোদনার প্রত্যাশা জানান মীরণ হোসেন মিলন।