ফলে নগরীর সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশেই এবার দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্ত বিরোধিতার মুখে পড়তে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা।
এর মধ্যে ১২টি ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলররাই ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়ে থাকছেন। এর বাইরে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা প্রার্থী হিসেবে রয়ে গেছেন।
বর্তমান যে ১২ কাউন্সিলর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি তাদের বেশিরভাগই নগরীর রাজনীতিতে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির মেয়র হলেও এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি।
সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হলেও কাউন্সিলর ভোট হয় নির্দলীয়ভাবে।
এক্ষেত্রে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও দলগুলো প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন কাউন্সিলর ঠিক করে দিয়ে থাকে, যাকে দলের পক্ষ থেকে সমর্থন দেওয়া হয়।
আগামী ২৯ মার্চ অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের কাউন্সিলর প্রার্থী ঠিক করার পর তালিকা দেখে নাছির নিজেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
পরে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন। মহানগর কমিটি থেকেও একই আহ্বান জানানো হয়।
এরপর শনিবার রাতে এই সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বাসায় বৈঠকে বিদ্রোহীদের কড়া বার্তা দেওয়া হয়।
রোববার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বসেন চট্টগ্রামের নেতাদের সঙ্গে। এরপর কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বিদ্রোহীদের ভবিষ্যতে ‘রাজনীতি করা কঠিন’ করার হুঁশিয়ারিও দেন।
কিন্তু রোববার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর দেখা যায়, কয়েকজনই কেবল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন।
সরে দাঁড়ালেন যারা
পাঁচটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের আলোচিত বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। তবে তাদের মধ্যে কেউই বর্তমান কাউন্সিলর নন।
এরমধ্যে ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ছয়জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন।
এরা হলেন বর্তমান কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের ভাই রাজীব দাশ সুজয়, সাবেক কাউন্সিলর এম এ নাসের ও বিজয় কিষাণ চৌধুরী, ফরহাদুল ইসলাম রিন্টু, আবদুল হান্নান ও সুচিত্রা গুহ।
এছাড়া ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। তিনি ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হলেও এখন জামিনে আছেন।
১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ করিম টিটু প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন।
৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক খালেদ হোসেন খান ও নাজিম উদ্দিন চৌধুরী এবং জানে আলম জিকু প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন।
৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা একেএম জাবেদুল আলম সুমন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন।
বিদ্রোহী সেই ১২
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটের লড়াইয়ে থাকা বর্তমান কাউন্সিলররা হলেন- ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের তৌফিক আহমেদ চৌধুরী, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের সাহেদ ইকবাল বাবু, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জহুরুল আলম জসীম, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে সাবের আহমেদ, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডের এফ কবির মানিক, ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডের এস এম এরশাদ উল্লাহ, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের এইচ এম সোহেল, ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডের আব্দুল কাদের ওরফে মাছ কাদের, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের তারেক সোলায়মান সেলিম, ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ডের হাসান মুরাদ বিপ্লব ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের মাজাহারুল ইসলাম চৌধুরী।
আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই ১২ জনের মধ্যে মধ্যে আটজন নানা কারণে সমালোচিত।
এদিকে দলের মনোনয়ন চেয়েও না পেয়ে এবার প্রার্থী হননি ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের মোহাম্মদ হোসেন হিরণ এবং ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের মো. জয়নাল আবেদীন।
বহিষ্কারের চিন্তা
রোববার বিকালের বৈঠকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার নির্বাচন পরিচালনায় সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি মণড্লীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে দিয়েছিলেন।
বিদ্রোহী প্রার্থীরা থেকে যাওয়ার পর রাতে জানতে চাইলে মোশাররফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের সবাইকে এক্সপেল করা হবে।”
নগর কমিটির সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শুধু মেয়র এবং দল মনোনীত কাউন্সিলরদের জন্যই কাজ করব। যারা বাইরে থাকবে তাদের বিষয়ে আমাদের কোনো দায় থাকবে না।
“দুই-চারদিনের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। তা না হলে গঠনতান্ত্রিক ব্যবস্থ অবশ্যই নেওয়া হবে।”
নগর কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর অন্য এক সদস্য জানান, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে দু-তিন দিন অপেক্ষা করার। এরপর পরিস্থিতি দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বর্তমান কাউন্সিলররা বিদ্রোহী হিসেবে ভোটের মাঠে থাকলে এর প্রভাব মেয়র নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা আওয়ামী লীগের।
নাছিরকে বদলে এবার আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী করেছে এম রেজাউল করিম চৌধুরীকে। বিএনপি প্রার্থী করেছে শাহাদাত হোসেনকে।
নারী কাউন্সিলর প্রার্থী পরিবর্তন
বিদ্রোহীদের নিয়ে দিনভর আলোচনা, বৈঠক, হুঁশিয়ারিরে পর তিনটি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে পরিবর্তন এনেছে আওয়ামী লীগ।
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পরিবর্তন আসা তিনটি সংরক্ষিত ওয়ার্ড হল ৩, ৫ ও ১১ নম্বর।
এরমধ্যে ৩ নম্বর সংরক্ষিত (৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড) আসনে জোহরা বেগমের পরিবর্তে বর্তমান কাউন্সিলর জেসমিন পারভীন জেসিকে প্রার্থী করা হয়েছে।
৫ নম্বর সংরক্ষিত (১৪, ১৫, ২১) ওয়ার্ডে আনজুমান আরাকে প্রার্থী করা হয়েছে। এর আগে এই পদে শিউলি দে নামের একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নির্ধারিত বয়সের কম হওয়ায় তিনি মনোনয়নপত্র জমাই দিতে পারেননি।
১১ নম্বর সংরক্ষিত (২৮, ২৯, ৩৬) ওয়ার্ডে শুরুতে আওয়ামী লীগ জিন্নাত আরাকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। তা পরিবর্তন করে বর্তমান কাউন্সিলর ফেরদৌসী আকবরকে প্রার্থী করা হয়েছে।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে রদবদল
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতিতে বৈঠকে সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।
কমিটির উপদেষ্টা পদে থাকবেন দলের উপদেষ্টা ড. অনুপম সেন। চেয়ারম্যান পদে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনই থাকছেন। তবে সদস্য সচিব হবেন আ জ ম নাছির উদ্দীন।
এরআগে সমন্বয়ক পদে ছিলেন মোশাররফ হোসেন, সদস্য সচিব ছিলেন নগরের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল।
বৈঠকে থাকা এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আ জ ম নাছির বৈঠকে বলেন, নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের সদস্য সচিব হওয়া সাংগঠনিক রীতি। সেটা না করে অন্য কাউকে কীভাবে করা হল? এরপর ওবায়দুল কাদেরও তাতে সম্মতি দেন।”
পুনর্গঠিত কমিটিতে চারজনকে কো-চেয়ারম্যান করা হয়, তারা হলেন নগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, উত্তর জেলার সভাপতি এম এ সালাম, দক্ষিণ জেলার সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদ ও নগরের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল।
কমিটি পুনর্গঠনের বিষয়টি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে স্বীকার করেছেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ।