নাছির, নাকি ছালাম কিংবা সুজন

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে বন্দরনগরীর রাজনৈতিক অঙ্গনে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Feb 2020, 03:38 AM
Updated : 14 Feb 2020, 11:39 AM

পরিবর্তনের গুঞ্জনে নগর ক্ষমতাসীন দলের নেতা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, এমনকি রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত নন এমন ব্যক্তিরাও মেয়র পদে লড়তে আওয়ামী লীগর মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।

বর্তমান মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের পাশাপাশি মনোনয়নের এই দৌড়ে আলোচনায় এগিয়ে আছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ও নগর কমিটির সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের চাওয়া, জনমানুষের উন্নয়নে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবেন না এমন একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মেয়রপ্রার্থী করা হবে।

অন্যদিকে জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী ও জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল প্রার্থী দেখতে চাইলেও দলীয় বিবেচনায় তার সুযোগ কতটুকু সেবিষয়ে সন্দিহান চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ।

ফের মেয়র হতে চান নাছির

দুয়েকটি উদ্যোগের জন্য প্রশংসিত হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে বিরোধ ও জলাবদ্ধতাসহ উন্নয়নমূলক নানা কর্মকাণ্ডে আলোচিত-সমালোচিত মেয়র আ জ ম নাছির আবারও মেয়র হতে চান। দলীয় মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন তিনি।

আ জ ম নাছির উদ্দীন

প্রতিশ্রুতির ৯০ শতাংশ পূরণ করেছেন দাবি করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, লোভ-লালসা, অনিয়ম-দুর্নীতির উর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। আবার সুযোগ পেলে বাকি কাজ শেষ করে মাদক-জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত নিরাপদ বাসযোগ্য বিশ্বমানের নগরী গড়ে তোলার যে স্বপ্ন তা পূরণে এগিয়ে যাব।

“আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা করেন তাই চূড়ান্ত, আমাদের প্রিয় নেত্রীর সিদ্ধান্ত শিরোধার্য।”

কেন্দ্রদখল ও কারচুপির অভিযোগে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী এম মনজুর আলমের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলের ভোটে জয়ী হন আ জ ম নাছির।

ভোটের আগে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন সিটি করপোরেশনের একার দায়িত্ব নয়।

তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরী থেকে সব বিলবোর্ড উচ্ছেদ ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় তার ‘ডোর টু ডোর’ কার্যক্রম প্রশংসিত হয়।

কিন্তু নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। মহিউদ্দিন ও নাগরিক আন্দোলনের বিরোধিতার মুখে গৃহকর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েও সরে আসতে বাধ্য হন নাছির।

এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণ, কর্ণফুলীর তীরে মৎস্য অবতরণকেন্দ্র ও আউটার স্টেডিয়ামের মাঠে সুইমিং পুল নির্মাণ নিয়েও পরস্পর বিরোধী অবস্থানেই ছিলেন দুই নেতা।

মেয়াদের শেষ দিকে ফুটপাতে হকার আংশিক নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের ধাক্কা কিছুটা সামলে ওঠেন নাছির। কিন্তু ওয়াইফাই জোন নির্মাণ, কর্ণফুলী রক্ষা, তথ্য প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা, শিক্ষার্থীদের বাসভাড়ায় ভর্তুকি, নারীদের জন্য আলাদা বাস চালু ও আবাসন সংকট নিরসনসহ নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি।

আশাবাদী ‘মহিউদ্দিনঘনিষ্ঠ’ ছালাম

চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নগরের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম ২০০৯ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান।

আবদুচ ছালাম

তার দায়িত্বের প্রায় ১০ বছরে নগরীর বেশকিছু সড়ক সম্প্রসারণ, নতুন আউটার রিং রোড, বাইপাস রোড, বাকলিয়া এক্সেস রোড নির্মাণ ও একাধিক ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সিডিএ।

ফ্লাইওভার নির্মাণ নিয়ে সমালোচনার মুখে থাকলেও তার চেষ্টায় ২০১৭ সালের ৯ অগাস্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ের বড় প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক।

দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে ছালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি আশাবাদী। নেত্রী দায়িত্ব দিলে চেষ্টা করব চট্টগ্রামের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে। দায়িত্ব পালনকালে প্রমাণ করেছি, যে কোনো কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারি।”

আছেন ‘বঞ্চিত’ নেতা সুজন

মনোনয়ন দৌড়ে আছেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনও।

খোরশেদ আলম সুজন

একসময় মহিউদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত থাকলেও পরে নাছিরেরও কাছাকাছি আসেন তিনি।

দীর্ঘদিন ধরে দলীয় রাজনীতি করলেও চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে অবহেলিত নেতা হিসেবে আলোচিত সুজন কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে নাগরিক আন্দোলনে কর্মসূচি নিয়ে সরব ছিলেন তিনি।

খোরশেদ আলম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার সমগ্র রাজনৈতিক জীবন বিবেচনা করে নেত্রী যদি আমাকে মনোনয়ন দেন তাহলে নগরবাসীর জন্য কাজ করব।

“চট্টগ্রামের মানুষ আমাকে ভালোবাসে, নগরবাসীর নাড়ির খবর আমি জানি।”

প্রার্থী হতে চান ব্যবসায়ী নেতারাও

চট্টগ্রামেও আওয়ামী রাজনীতির সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত বা এই ঘরানার ব্যবসায়ী নেতাদেরও মেয়র পদে মনোনয়ন নিয়ে আলোচনা আছে।

দলীয় মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন নগর কমিটির সহ-সভাপতি ও সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ ও প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্য জহুর আহমদ চৌধুরীর সন্তান ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান।

জানতে চাইলে তুফান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রী যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাই হবে। উনি যোগ্য মনে করে আস্থা রাখলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এর বাইরে কিছু বলার নেই।

এছাড়া আলোচনায় থাকা চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বুধবার পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন ফরম নেননি।

নিজের অনাগ্রহের কথা জানালেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত মেয়র পদে আলোচনায় ছিলেন সাবেক মেয়র প্রয়াত মহিউদ্দিনের ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

মেয়র পদে মনোনয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, “চট্টগ্রামের মানুষ এমন মেয়র চায় যিনি সমাজবিরোধী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের প্রশ্রয় দেবেন না। সিটি করপোরেশনের সব সম্পদ নিয়ে মানুষের মৌলিক সেবা নিশ্চিত করবেন, সদয় থাকবেন এবং সবাইকে নিয়ে কাজ করেবন।

“তবে আওয়ামী লীগে যোগ্য প্রার্থীর অভাব নেই। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।”

শেষ সময়ে এসে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন এম মনজুর আলমও, যিনি বিএনপির সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে একবার মেয়র হয়েছিলেন।

তৃণমূলের নেতাকর্মী ও নাগরিকদের প্রত্যাশা

কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান মনসুর বলেন, “আমরা তৃণমূলের কর্মীরা চাই জনবান্ধব, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং উন্নয়ন করতে সক্ষম মেয়র প্রার্থী। যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচন তাই দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি জনগণের পাশে থাকা প্রার্থীই প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ভবন

“দীর্ঘ ১৭ বছর মেয়র থাকাকালে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের মানুষের স্বার্থে অনেক বড় ঝুঁকি নিতেও পিছপা হননি। সেরকম প্রার্থী চাই যিনি মহিউদ্দিন চৌধুরীর মত মানুষের পাশে থাকবেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে বিজয়ী হতে পারবেন।”

নগর কমিটির অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা সহ-সভাপতি ও সিডিএর চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমককে বলেন, “নেত্রী দল পরিচালনা করেন, দেশও চালান তিনি। তার কাছে সব খোঁজই আছে। উনি যাকে যোগ্য মনে করেন তাকেই প্রার্থী করবেন। আমরা সেই প্রার্থীর জন্য কাজ করব।

মেয়র পদে প্রার্থী বিষয়ে নাগরিক প্রত্যাশা নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজ ও টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বিডিনিউজকে বলেন, “নাগরিকদের চাওয়া সৎ, যোগ্য জনকল্যাণমুখী নারী-পুরুষের সমতা এবং সর্বোপরি জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী মেয়র প্রার্থী, যার কমিটমেন্ট থাকবে জনগণের প্রতি।

“যিনি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা, যানজট ও ফুটপাত দখলমুক্ত করবেন এবং সিটি করপোরেশনকর দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবেন সেরকম প্রার্থী চাই। কিন্তু যেহেতু দলীয় মনোনয়ন তাই দলের ভেতর পছন্দ-অপছন্দসহ অনেক অদৃশ্য ফ্যাক্টর কাজ করবে। প্রার্থীর বিষয়ে জনপ্রত্যাশার মূল্যায়ন হয়ত আগের চেয়ে তাই আরও দুরূহ হবে এবার।”