দীর্ঘ সময় মামলাগুলো তদন্ত পর্যায়ে আটকে থাকায় নিহতদের স্বজনরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ প্রকাশ করেছেন ক্ষোভও।
অঞ্জলী হত্যাকাণ্ড
হত্যাকাণ্ডের দিন বিকালে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন তার স্বামী ডা. রাজেন্দ্র চৌধুরী। শুরু থেকে মামলাটি তদন্ত করছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস পর পটিয়ার এক মাদ্রাসা কর্মকর্তাকে আটক করে এই মামলায় হেফাজতে নিয়েছিল পুলিশ।
এরপর বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার তিন জঙ্গি ও এসপিপত্নী মিতু হত্যাকাণ্ডে অস্ত্র সরবরাহ করা এহেতাশামুল হক ভোলাকেও এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় গোয়েন্দা পুলিশ। তবে এখনও হত্যাকাণ্ডের কারণ অজানা।
তবে ‘পরিকল্পিত’ এই হত্যাকাণ্ডটি পেশাদার খুনিদের হাতেই হয়েছিল বলে শুরু থেকেই ধারণা করছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে সাতবার। সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আছেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক বিশ্বজিৎ বর্মন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, আগের তদন্ত কর্মকর্তাদের মত তিনিও হত্যাকারীদের শনাক্তে কাজ করছেন।
“মামলার নতুন কোনো অগ্রগতি নেই। হত্যাকাণ্ডে চারজন অংশ নিয়েছিল বলে প্রথম থেকেই নিশ্চিত হয়েছিল পুলিশ। তাদের শনাক্তে কাজ করছি।”
এদিকে ছয় বছরেও মামলার কোনো কূলকিনারা না হওয়ায় তদন্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী রাজেন্দ্র চৌধুরী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শুধু হচ্ছে হবে বলা হচ্ছে। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে কিছুই করতে পারেনি ডিবি। এমনকি হত্যাকাণ্ডের পরপর আমাকে যে টেলিফোনে হুমকি দেয়া হয়েছিল সেটা নিয়েও একটি মামলা করেছিলাম। সে মামলাটির বিষয়েও কিছু করতে পারেনি পুলিশ।”
অঞ্জলীর দুই মেয়ে এখন সরকারি চিকিৎসক। চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন রাজেন্দ্রও। তিনি তার বর্তমান বসবাসের স্থান জানাতে রাজি হননি।
রাজেন্দ্র বলেন, “আমার ৬৬ বছর বয়স হয়েছে। শারিরীকভাবে অসুস্থ। নিজেও এখন প্র্যাকটিস করি না। আগে মাস তিনেক পরপর চট্টগ্রাম গেলেও এখন অনলাইনে পেনশন নিতে পারায় চট্টগ্রামেও যাই না।”
এদিকে চাকরিরত অবস্থায় অঞ্জলী মারা গেলেও সরকারি অনুদানের টাকাও তার পরিবার পায়নি বলে জানান তিনি।
রাজেন্দ্র বলেন, “তার টাকার অধিকার আমার মেয়েদের। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দফায় দফায় টাকা খরচ করেছি। কিন্তু সে টাকা পাইনি।”
তদন্ত কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ বলেন, হুমকির পর থেকেই মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। যে সিম ব্যবহার করে হুমকি দেওয়া হয়েছিল সেটির নিবন্ধন ভুয়া হওয়ায় কাউকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
স্কুল ছাত্রী ইনহাস হত্যা
কিন্তু দুই বছরেও তদন্তে অগ্রগতি নেই। হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ ইনহাসের চাচীর ছোট ভাই শিক্ষানবীশ আইনজীবী রিজুয়ানুল কবির নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছিল। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু পায়নি।
মেয়ের হত্যা মামলার তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন ইনহাসের বাবা নাছির উদ্দিন।
“দুই বছর হতে চললেও এখনও মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেও জামিনে ছাড়া পেয়েছে।”
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা নাছির দেশে ফিরে এসেছেন মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েই।
নাছির বলেন, “মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েই আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। সৌদি আরবের ভিসা বাতিল করে দেশে চলে এসেছি। এখন অপর সন্তানদের নিয়ে থাকতে চাই।”
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক স্বপন কান্তি বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলাটি এখনও তদন্তের পর্যায়ে আছে। আশা করি দ্রুত সময়ে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারব।”
কাস্টমস কর্মীর রিপেন সিংহ
ময়না তদন্তে রিপেনকে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এই ঘটনায় রিপেনের বাবা ক্ষুদিরাম সিংহ তার বড়ছেলের স্ত্রী ও স্ত্রীর বড় ভাইকে আসামি করে কোতোয়ালী থানায় মামলা করেন। পরে বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলা যায় পিবিআইতে।
এর কয়েকমাস পর রিপেনের স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়িসহ আরও আটজনের নাম সংযুক্তির আবেদন করে আদালতে। তবে প্রায় দুই বছর হলেও এই মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক সন্তোষ চাকমা জানান, “রিপেনের বাবা বিভিন্ন সময়ে একেক জনের নাম দিচ্ছেন। প্রথমে দুইজনকে আসামি করা হলেও পরে রিপেনের স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়িসহ আরও আটজনের নাম দিয়েছেন। এভাবে মোট ৩১ জনের নাম দিয়েছেন তার বাবা।
“এভাবে বিভিন্ন সময়ে আসামিদের নাম দেয়ায় আমাদের তদন্ত ব্যাহত হচ্ছে।”
তবে মামলাটি নিয়ে তারা দ্রুত একটি সিদ্ধান্তে যাবেন বলে জানান সন্তোষ চাকমা।
আইনজীবীর স্ত্রী খুন
পরদিন নিহতের মা বেদোরা বেগম চান্দগাঁও থানায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। থানা, গোয়েন্দা পুলিশ ঘুরে মামলাটির এখন তদন্তে আছে পিবিআই।
হত্যাকাণ্ডের পর এহতেশামুল পারভেজ সিদ্দিকী জুয়েল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সকালে তিনি আদালতে চলে যান। বিকালে বাসায় ফিরে ঘর তছনছ ও মেঝেতে হাত-পা বাঁধা স্ত্রীর লাশ দেখতে পান।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগের স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর রহিমাকে বিয়ে করেছিলেন জুয়েল।
লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশের তৈরি সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, আঘাত ও শ্বাসরোধে বিবি রহিমাকে খুন করা হয়। তার গলা বাম দিকে বাঁকানো ছিল। যে ওড়নায় গলা পেঁচানো হয় সেটি দিয়েই পা বাঁধা হয়েছিল। আর লাল রঙের একটি গামছা দিয়ে পায়ের গোড়ালি বাঁধা ছিল।
ঘটনার পরপর থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তারা নিশ্চিত বিবি রহিমাকে খুন করে হাত-পা বাঁধা হয়েছিল।
মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন পিবিআইর পরিদর্শক আনোয়ার উল্লাহ। পিবিআইতে তিনি মামলাটির দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, প্রযুক্তিগত বিভিন্ন দিক নিয়ে তারা মামলাটির তদন্ত করছেন।
“হত্যাকান্ডের সময় কয়জন ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিল সেটা আমরা তদন্ত করছি। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলে সবকিছু বের করা যাবে।”
মামলার বিষয়ে কথা বলতে রহিমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে কাউকে পাওয়া যায়নি।