লালদীঘি হত্যাকাণ্ড: প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেদিনের বিভীষিকা

একত্রিশ বছর আগে লাল হয়েছিল চট্টগ্রামের মাটি;  লালদীঘি মাঠের কাছে পুলিশের সেই গুলিবর্ষণকে বর্বরতা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা; ওই হত্যাকাণ্ডের রায়ে আদালত বলেছে, তা ছিল গণহত্যা।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2020, 02:54 PM
Updated : 20 Jan 2020, 02:54 PM

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি দুপুরে লালদীঘি মাঠের কাছে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশের গুলিতে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল, সেই হত্যাকাণ্ডের মামলাটির রায় হল সোমবার, যাতে জীবিত পাঁচ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।

আদালতে দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে সেদিনের বিভীষিকা।

ঢাকা থেকে সেদিন সকালে বিমানে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বিমানবন্দরে নামার পর বেলা ১১টার দিকে একটি খোলা ট্রাকে দলীয় নেতাদের সঙ্গে নগরীর দিকে যাচ্ছিলেন তিনি।

এইচ এম এরশাদের আমলে সেদিন লালদীঘিতে আওয়ামী লীগকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। লালদীঘির মাঠে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। তাই সমাবেশস্থল নির্ধারণ করা হয় মাঠের পাশেই জেলা পরিষদ চত্বরে।

চট্টগ্রাম আদালত ভবনে আইনজীবী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কর্মসূচিও ছিল শেখ হাসিনার।

দুপুরে চট্টগ্রামের আদালত ভবনে যাওয়ার পথে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে আসা নেতা-কর্মীদের উপর পুলিশ গুলি চালায় পুলিশ।

সেই ঘটনার বর্ণনায় ২০১৬ সালের ২৬ জুন আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, “সকাল ১১টায় বিমানবন্দর থেকে খোলা ট্রাকে করে নেত্রীকে নিয়ে লালদীঘি মাঠের দিকে আসছিলাম। ট্রাকে আখতারুজ্জামান বাবু, আশিকুর রহমান, ইসহাক মিয়াসহ নেতারা ছিলেন। পুরো সড়কজুড়ে ছিল জনস্রোত। বারিক বিল্ডিং মোড়ে আমি ট্রাক থেকে নেমে যাই।”

স্মৃতিস্তম্ভটি আগে ছিল এরকম, পরে সংস্কার করা হয়

নিউ মার্কেটে পৌঁছে তখনকার জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা সুজনের মোটর সাইকেলে করে শহীদ মিনারের দিকে গিয়েছিলেন মোশাররফ। ফিরে এসে দেখেন ট্রাক আর নিউ মার্কেট মোড়ে নেই।

“কোতোয়ালি থানার সামনে মোটর সাইকেল থেকে নামি। তখনই পুলিশ আমাকে লাঠিপেটা শুরু করে। ট্রাকটি তখন পুরাতন বাংলাদেশ ভবনের সামনে দাঁড়ানো।”

মোশাররফ বলেন, “সেদিন দেখেছি নেত্রীর সাহস। বিশৃঙ্খলভাবে গুলি করা হয়। তখন ট্রাকে দাঁড়িয়ে মাইকে নেত্রী বলেন- খবরদার, মোশাররফ ভাইকে পেটাবেন না।

“তারা কথা শোনেনি। মারতে মারতে আমাকে নালায় ফেলে দেয়। ‍গুলির শব্দ শুনেছি। পরে আইনজীবীরা গিয়ে মানবঢাল তৈরি করে নেত্রীকে চট্টগ্রাম বারের কার্যালয়ে নিয়ে আসেন।”

“শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে সেদিন গুলি চালানো হয়েছিল। উনাকে লক্ষ্য করে চালানো গুলি ভাগ্যক্রমে গায়ে লাগেনি,“ বলেন মোশাররফ।

২০১৬ সালের ২৬ মে আদালতে সাক্ষ্যে সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, “আনুমানিক বেলা ১টার দিকে ট্রাকটি আদালত ভবনের দিকে আসার সময় গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বিভিন্ন জনকে গুলি খেয়ে আমি কাতরাতে দেখিছি। অনেককে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করতেও দেখেছি। পরে শুনেছি, গুলিতে মোট ২৪ জন মারা গেছেন।”

অনুপম সেন বলেন, “গুলিতে নিহতদের কারও লাশ পরিবারকে নিতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। হিন্দু-মুসলিম নির্বিচারে সবাইকে বলুয়ার দীঘি শ্মশানে পুড়ে ফেলে।”

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোতোয়ালির মোড়ে সড়কে ব্যারিকেড ছিল। গাড়িবহর আসার পর ব্যারিকেড তুলে নেওয়া হয়। গাড়িবহর এগিয়ে যায়।

“বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের কাছাকাছি গেলে কোতোয়ালির দিক থেকে এবং বিপরীত দিক থেকে একসাথে গুলি করা হয়।”

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা তুলে ধরে রায়ে বলা হয়, “পথে তিনটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়। কোতোয়ালি মোড়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এবং লালদীঘি এলাকায়। কৌশলে প্রথম ব্যারিকেডটি সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর তারা ভিতরে ঢুকলে জে সি মণ্ডল (আসামি) ওয়ারলেসে জানায়-‘ চলে আসছে’।

“মীর্জা রকিবুল হুদার (প্রয়াত আসামি) ওয়াকিটকির মাধ্যমে নির্দেশ দেয়- ‘গুলি করে শোয়াইয়া ফেল, গুলি করে হামাইয়া ফেল’।”

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৪ আসামিকে চট্টগ্রামের আদালত থেকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে।

মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই পুলিশ সদস্য। তারা হলেন- চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি অঞ্চলের তৎকালীন পেট্রোল ইনসপেক্টর জে সি মণ্ডল, কন্সটেবল মোস্তাফিজুর  রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। জে সি মণ্ডল পলাতক আছেন।

বাকি তিন আসামি সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা এবং কনস্টেবল আব্দুস সালাম ও বশির উদ্দিন বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তারা মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

ঘটনার পর পুরো চট্টগ্রামে পুলিশ নির্বিচারে গুলি ও ধরপাকড় চালায় বলে জানান ইফতেখার সাইমুল।

তিনি বলেন, “ঘটনার পরপর নেত্রীকে আইনজীবীরা ঘিরে আদালতে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন। পরে তিনি চলে যান।

“এরপর থেকে লালদীঘি পাড়ের আশেপাশে, নিউ মার্কেট, গ্র্যান্ড হোটেল, দোস্ত বিল্ডিং, আমতলসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ গুলি চালায়। পরদিন হাসপাতালে গিয়ে অনেককে আহত-রক্তাত দেখতে পাই। বিভীষিকা পূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন।”

২০১৬ সালের ৩১ জুলাই আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে দৈনিক পূর্বকোণের সাংবাদিক অঞ্জন সেন আদালতে বলেছিলেন এরশাদ আমলে সেই ঘটনার ছবি প্রকাশে বাধা পাওয়ার কথা।

সেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরনো ভবনের সামনে থাকা অঞ্জন বলেছিলেন, পুলিশের লাঠিপেটা ও গুলি করার দৃশ্য দেখে তারা একটি নালায় নেমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে অফিসে গিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন জমা দিয়ে তিনি হাসপাতালে গিয়ে অনেকের লাশ দেখতে পান। এরপর বলুয়ারদিঘী মহাশ্মশানে গিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্যও দেখেন।

তবে সেদিনের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশ করা যায়নি জানিয়ে এই সাংবাদিক বলেন, “অফিসে পুলিশ গিয়ে রিপোর্ট ও ছবিগুলো নিয়ে এসেছিল।”