লালদীঘির ঘটনা পরিকল্পিত গণহত্যা, বললেন বিচারক

তিন দশক আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের কাছে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলি করে ২৪ জনের হত্যার ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছে আদালত।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2020, 01:27 PM
Updated : 20 Jan 2020, 01:36 PM

সোমবার বিকালে চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন।

এছাড়া বিনা উসকানিতে গুলি করে শত শত নিরীহ লোককে আহত করায় দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারায় তাদের প্রত্যেককে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

দণ্ডিতরা হলেন- চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি অঞ্চলের তৎকালীন পেট্রোল ইনসপেক্টর জে সি মণ্ডল, কন্সটেবল মোস্তাফিজুর  রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। এদের মধ্যে প্রথম জন পলাতক।

রায় ঘোষণার পর আদালতকক্ষের বাইরে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মিছিল শুরু করেন আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা।

তারা বলেন, দেরিতে হলেও স্বৈরাচারীভাবে দমন-পীড়নকারী ও তাদের রক্ষার চেষ্টাকারীদের যে বিচার হয়েছে- এটা দৃষ্টান্তমূলক।

আদালতে সাক্ষীদের দেওয়া সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য ছিলেন সে সময়ের আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

‘বিভিন্ন কারণে’ মামলাটির বিচার কাজ শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগলেও সন্তুষ্টি জানিয়েছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরাও।

আগের রাতে বৈঠক, ওয়াকিটকিতে নির্দেশ

রায় ঘোষণা আগে সাক্ষীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনার একটি চিত্র তুলে ধরে বিচারক বলেন, এটা ‘মাস কিলিং’ (গণহত্যা)।

“যা জানতে পেরেছি, সে সময়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে পথসভা করতে করতে লালদীঘির দিকে আসছিলেন। জেলা পরিষদ এলাকায় পেশাজীবীদের সাথে মতবিনিময় হওয়ার কথা ছিল।”

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বন্দরনগরীর লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভার দিন বেলা ১টার দিকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক আদালত ভবনের দিকে এগোলে নির্বিচার গুলি ছোড়া শুরু হয়।

আইনজীবীরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে ঘিরে মানববেষ্টনি তৈরি করে তাকে নিরাপদে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিয়ে যাওয়ায় তিনি রক্ষা পান। কিন্তু ২৪ ছাত্র-জনতার প্রাণ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়।

ওই দিনের ঘটনার চিত্র তুলে ধরে বিচারক ইসমাইল বলেন, “(শেখ হাসিনার আসার) পথে তিনটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়- কোতোয়ালী মোড়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ও লালদীঘি এলাকায়। কৌশলে প্রথম ব্যারিকেডটি সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর তারা (শেখ হাসিনার গাড়ি বহর) ভেতরে ঢুকলে জে সি মণ্ডল ওয়ারলেসে জানায়, চলে আসছে।

“মীর্জা রকিবুল হুদা (সিএমপি কমিশনার) ওয়াকিটকির মাধ্যমে নির্দেশ দেয়, গুলি করে শোয়াইয়া ফেল, গুলি করে হামাইয়া ফেল (শেষ করে দাও)।”

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির সেই ঘটনার আগের রাতেই আসামি মীর্জা রকিবুল হুদা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন বলে এই আদালতের পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, চান্দগাঁও থানার তৎকালীন ওসি সাহাবুদ্দিন তার সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার আগের দিন সে সময়ের পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদা লালদীঘি সমাবেশে বলপ্রয়োগের কথা বললে অন্য কর্মকর্তারা বিরোধিতা করেছিলেন। তখন রকিবুল হুদা ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ করেন।

“এতে প্রমাণ হয় গুলিবর্ষণ ছিল পূর্ব পরিকল্পিত এবং লক্ষ্য ছিলেন নেত্রী শেখ হাসিনা।”

আদালতের সেরেস্তাদার এস এম মোর্শেদ রায় উদ্ধৃত করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিএমপি কমিশনারের এই নিদের্শে পিআই (পেট্রোল ইন্সপেক্টর) জে সি মণ্ডলের হুকুমে আসামিরা এলোপাতাড়ি রাইফেলের গুলি ছুড়তে শুরু করে। নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে ২৪ জন ছাত্র-জনতা মারা যান।

‘হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্ট ও গোপন করার জন্য’ রকিবুল হুদার নির্দেশে নিহতদের মৃতদেহ ধর্ম নির্বিশেষে শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়।

কিন্তু বিচারের মুখোমুখি হয়েও গর্হিত অপরাধের জন্য সাজার আগেই মারা যান সিএমপির কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা। আরও দুই আসামি কনস্টেবল আব্দুস সালাম ও বশির উদ্দিনও এর মধ্যে মারা গেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শম্ভু প্রসাদ বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালত বলেছেন- রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে এটা গণহত্যা। গণহত্যা যে পূর্ব পরিকল্পিত সেটার প্রমাণ তখনকার পুলিশ সদস্যরা আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যতে দিয়েছেন।

“রায়ে আমরা সন্তুষ্ট, আমরা দায়মুক্ত হলাম।”

৩২ বছর আগের ওই ঘটনায় হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, কাসেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও শাহাদাত হোসেন নিহত হন।

এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে এঘটনায় মামলা দায়ের করলেও বিএনপি সরকারের সময়ে মামলার কার্যক্রম এগোয়নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। দুই দফা তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর আট পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।

গত ১৪ জানুয়ারি ৫৩তম সাক্ষী আইনজীবী শম্ভুনাথ নন্দীর সাক্ষ্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওইদিন আদালত যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ১৯ জানুয়ারি দিন ঠিক করেন।

রোববার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী যুক্তি উপস্থাপন শেষে পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। পরে আদালত আসামি পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য সোমবার দিন রেখেছিলেন।

কিন্তু আসামিপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন না করায় এদিনই আদালত রায় ঘোষণা করেন।