মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে কৃষক লীগের এক অনুষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটে।
নিজের বক্তব্যে মেয়রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের পর অনু্ষ্ঠানস্থল ছেড়ে যান জাহেদা। পরে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত করার জন্য মেয়র নাছিরকে দায়ী করেন তিনি।
বিজয় দিবস উপলক্ষে মহানগর কৃষক লীগ আয়োজিত এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দ্র চন্দ।
মহানগর কৃষক লীগের সভাপতি আলমগীর হোসেনের সভাপতিত্ব ও সাধারণ সম্পাদক কাজী আনোয়ার হাফিজের সঞ্চালনায় সভায় দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকবিরোধী শপথবাক্য পাঠ করান সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।
নগর কৃষক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক জাহেদা আমিন চৌধুরী ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কয়েকজন নেতার বক্তব্যের পর ডায়াসে আসেন তিনি। উনার বক্তব্য চলার কয়েক মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
“এরপর আমার খারাপ লাগে। দিয়াজের বিষয়টা মনে পড়ে যায়। বক্তব্যে আমি প্রশ্ন করি, উনার ছত্রচ্ছায়ায় কেন খুনিরা বহাল তবিয়তে আছে?”
জাহেদা আমিন বলেন, “তারপর প্রশ্ন করলাম একবার হত্যা করার পর কেন মিথ্যা রিপোর্ট (ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন) দিয়ে আবার হত্যা করতে হল? দিয়াজের লাশের ময়নাতদন্তের আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার কেন আপনার বাসায় গিয়েছিল? কেন দিয়াজের বিচারে উনি পাশে নাই? এসব প্রশ্ন করতেই উনার সমর্থকরা হৈ হৈ করা শুরু করে।
“এর পর মেয়র নিজেই বলেন, আমি সব সময় আপনাদের পাশে আছি। জবাবে আমি বলি, মিথ্যা কথা। আপনার কারণে সিআইডি চার্জশিট দিতে পারছে না। আপনি আমাকে বলেছিলেন আসামির তালিকা থেকে আলমগীর টিপুর নাম বাদ দিতে। আমি বাদ দিইনি বলে আপনি চার্জশিট দিতে দিচ্ছেন না। এসব কথা বলার পর আমাকে কয়েকজন মিলে মঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। আমি একপাশে চেয়ারে বসে কাঁদতে থাকি।”
তারপর মেয়র বক্তব্য শুরু করলে খারাপ লাগায় অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়ে যান বলে জানান জাহেদা।
জাহেদা আমিন চৌধুরী বলেন, “আমি আমার ছেলে হত্যার বিচারের কথা বলেছি, অন্যায় কিছু করিনি।”
তিনি বলেন, “রায়হান ইউসুফ আর নীল শার্ট পরা একজন এসে বলে, এসব উল্টাপাল্টা কেন করছেন? ভালো হবে না। তারা আমাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে। আমি তখন বলেছি কী করবেন, মেরে ফেলবেন? মেরে ফেলে দিয়াজের পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেন।”
এরপর অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে চিৎকার করে জাহেদা আমিন বলতে থাকেন, “আপনারা আমার বক্তব্য আজকে তুলে ধরবেন। আজকে আবেগের মোহে এসব মায়ের সন্তানরা...তাদের কপালে কী আছে! দিয়াজের মতো একদিন হারিয়ে গেলে তাদের জন্য কেউ কথা বলবে না। ‘একটি নাম শোন নবীন/ আ জ ম নাছির উদ্দিন’-এটা দিয়াজের বানানো শ্লোগান, দিয়াজের তোলা শ্লোগান। আহারে দিয়াজ!”
জাহেদা আমিন চৌধুরী বলেন, “দিয়াজ, দিয়াজকে বলেছিলাম এমন একটা নেতার পাশ ধরেছিস উনি মানুষকে উঠতে দেয় না। মানুষ উঠতে গেলেই নাকি হত্যা করে। বলেছে, মা মানুষের কথায় কান দিয়েন না। আমাকে উনি নিজের সন্তানের থেকেও বেশি ভালোবাসে, বেশি ভালোবাসে।
“আমার সন্তান বিশ্বাস করে নাই মার কথা। আমার সন্তান বিশ্বাস করে নাই।”
তিনি বলেন, “আজকে একমাত্র উনার জন্য...। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। এই ক্ষমতা একদিন যাবে। মেয়র পদ ছাড়ুক, সাধারণ সম্পাদক পদ ছাড়ুক। তারপর দেখা যাবে কী আছে উনার বিচার। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।
“দিয়াজ হত্যার বিচার যে ধামাচাপা দিচ্ছে তাদের বিচার আল্লাহ করবে। আল্লাহ করবে।”
এসব বিষয়ে জানতে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মোবাইলে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরে মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী রায়হান ইউসুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কৃষক লীগের অনুষ্ঠানে দিয়াজের মা এসেছিলেন। বক্তব্য দেওয়ার সময় উনাকে দেখেছি। এরপর তিনি বাইরে গিয়ে বসলে তখন তার সাথে কথা হয়।
“দিয়াজের সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। মা তো মা-ই। তিনি একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, মেয়র সাহেব, আপনারা হেল্প করছেন না। আমরাও চাই এ ঘটনার বিচার হোক। এখন সিআইডি তদন্ত করছে। এটা তো একটা প্রক্রিয়া।”
রায়হান ইউসুফ বলেন, “আমি দিয়াজের মাকে বলেছি, আপনার কাকে কাকে সন্দেহ তাদের নাম দেন। আমরাও চেষ্টা করছি।”
হুমকি দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার সাথে কিছুই হয়নি। উনি বয়স্ক মানুষ। উনাকে সম্মান করি।”
তিনদিন পর ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করা হয়। তার ভিত্তিতে হাটহাজারী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করে পুলিশ।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্মাণ কাজের দরপত্র নিয়ে কোন্দলের সূত্র ধরে দিয়াজকে ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে’ বলে দাবি করে আসছিল পরিবার ও তার অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা বাদী হয়ে আদালতে হত্যামামলা করেন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সে সময়কার কমিটি ও সাবেক ১০ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। আসামি করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেনকেও।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি আলমগীর টিপু, ছাত্রলীগ নেতা আবুল মনসুর জামশেদ, তাদের অনুসারী রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরাব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমানও হন আসামি।
আসামিরা সবাই চট্টগ্রামের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দিয়াজও ছিলেন নাছিরেরই অনুসারী।
দিয়াজের মায়ের আবেদনে আদালত সিআইডিকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় দিয়াজের ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা।
২০১৭ সালের ৩০ জুলাই দেওয়া দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তারা বলেন, দিয়াজের শরীরে হত্যার আলামত রয়েছে।
এ প্রতিবেদনের পর দিয়াজের মায়ের করা এজাহার হত্যা মামলা হিসেবে নিতে হাটহাজারী থানাকে নির্দেশ দেয় আদালত।