মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণায় একাত্তরের চট্টগ্রাম

একাত্তরের রণাঙ্গনে চট্টগ্রামে প্রায় চারশ গেরিলা যুদ্ধ হয়েছিল, যার মধ্যে এক দিনেই মুক্তিযোদ্ধারা একশ অপারেশন চালিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2019, 05:17 PM
Updated : 13 Dec 2019, 05:17 PM

শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চট্টগ্রাম অফিস আয়োজিত ‘বিজয়ের শেষ তিন দিন, কেমন ছিল চট্টগ্রাম’ শীর্ষক এক গোল টেবিল আলোচনায় এসে স্মৃতিচারণ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার্স) এবং বিএলএফ (বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স) দুটো পক্ষই ছিল। বিএলএফের ৮টি এবং এফেএফের ১৭টি গ্রুপ সক্রিয় ছিল চট্টগ্রামে।

“শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ, আরেকটা গ্রুপে আমি। চট্টগ্রামে প্রায় চারশ গেরিলা অপারেশন হয়, যা দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে সংখ্যায় বেশি।”

সে সময় ‘হাই কমান্ডের’ নির্দেশে ডিসেম্বরের প্রথম দিন সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট থেকে আমিন জুট মিল হয়ে কালুরঘাট জুট মিল পর্যন্ত প্রায় একশ জায়গায় গেরিলা অপারেশন চলে।

“এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আগ্রাবাদ এলাকার বেইস ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। আমরা লুকিয়ে পড়ি,” বলেন মাহফুজুর রহমান। 

চট্টগ্রাম মুক্ত হওয়ার সেই মুহূর্ত স্মরণ করে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম শহরের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ জনগণ ছিল আমাদের পক্ষে। যুদ্ধে সাধারণ মানুষের অনেক অবদান।

“১৭ ডিসেম্বর সকালে ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন, মইন উদ্দিন খান বাদল, আমিসহ কয়েকজন রেডিও স্টেশন দখল করে ‘চট্টগ্রাম মুক্ত’ এই ঘোষণা দিই।”

স্মৃতিচারণে অংশ নিয়ে গেরিলা যোদ্ধা আবু সাইদ সরদার বলেন, “একাত্তরে আগ্রাবাদ মৌলভী সৈয়দ বেইস ক্যাম্পে অবস্থান করে এফএফ ও বিএলএফের ২৯টি গ্রুপ যুদ্ধ করেছিল। ৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে রেডিও স্টেশন দখল করে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে সে ঘোষণা আমরা দিই।”

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “১৪ ডিসেম্বর শক্রবাহিনী রাজাকারদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি হামলা চালিয়ে চিহ্নিত লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা বুঝতে পারিনি এটা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার অংশ।

“১৪ ডিসেম্বর রাতে মুহুরিপাড়া থেকে দুই জন বিহারীকে একটি মাইক্রোবাস থেকে আটক করি। পরে তাদের দেওয়া তথ্য মতে জামালখান হোটেল তাওয়াক থেকে শাকপুরা নিবাসী চার হিন্দু নারীকে উদ্ধার করি। তারা প্রত্যেকে কয়েক মাসের গর্ভবতী ছিল।”

আবু সাইদ সরদারের স্মৃতিচারণে উঠে আসে একাত্তরে পদে পদে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন সংশয়ের কথা। 

এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে যুদ্ধ করায় সবুজবাগে আমার বাড়িতে ১৭ বার হামলা হয়েছিল একাত্তর সালে। আমার মায়ের মুখে অস্ত্র ঠেকিয়েছিল সাকা চৌধুরীর ক্যাডার জল্লাদ জাফর উল্লাহ ও খোকা। পরে ১৬ ডিসেম্বর রাতে তাদের দুজনকে ওয়াপদা কলোনি থেকে ধরে ফেলি।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একাত্তরে 'চট্টগ্রামের ত্রাস' সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম খালেকুজ্জামান দাদুল স্মরণ করেন বিজয়ের দিনের অভিজ্ঞতা।

তিনি বলেন, “১৬ তারিখ আমি একটা রিকশা নিয়ে সার্কিট হাউজের সামনে আসি। তখনও বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলি হচ্ছিল। এর মধ্যেও আবার জনতা মিছিল বের করে উল্লাস করছিল।”

দাদুল বলেন, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেভাবে হোক আমি সার্কিট হাউজে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলব। সার্কিট হাউজে গিয়ে দেখি, লুটতরাজ চলছে। কেউ কেউ আসবাবপত্র নিয়ে বাইরে ফেলে দিচ্ছে। কেউ নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে টর্চার সেল বানানো হয়েছিল। যে চেয়ারে বসিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের টর্চার করা হত, আমি সেটা দেখেছিলাম।

“একটা তালিকা আমি সেখানে পাই, যা পাকিস্তানে করা হয়েছিল। সে তালিকায় চট্টগ্রামে শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মকর্তা কাদের হত্যা করা হবে তা লেখা ছিল। সেটি এখনো আমার কাছে আছে।

“আমি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে সার্কিট হাউজে যাই। নিজে স্ট্যান্ডে উঠতে পারিনি। চট্টগ্রাম কলেজের একজন ছাত্র ছিল, শামীম। তাকে তুলে দিই। সে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলে। আমি বাংলাদেশের পতাকা তাকে দিই। সে সেটা বেঁধে দেয়।”

সভা শেষে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, “এটা সত্য কথা যে, চট্টগ্রামে জনতা আগে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল। সার্কিট হাউজেও একদিন আগেই বাংলাদেশের পতাকা উঠেছিল, যদিও আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান হয়েছে একদিন পরে।

“১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করে। আমাদের এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পৌঁছাতে পারেননি, যেখানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। পরদিন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল।”

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এরপর চট্টগ্রাম হানাদারমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর। ওইদিন সার্কিট হাউজে মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে চট্টগ্রামকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম ও মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে প্রবেশ করেন। সেখানেই তাদের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।

আলোচনা সভার উদ্বোধন শেষে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, “২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষার্থীরাই হবে মূল চালিকা শক্তি। সে কারণে আপনাদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে হবে।”

বাসস চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান কলিম সরওয়ারের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা মো. হারিছ, ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সাহাবুদ্দিন, বিএলএফ কমান্ডার প্রফেসর মঈনুদ্দিন, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমদ ও মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু আলোচনায় অংশ নেন।