অসহায়ের ‘সাত বন্ধু’

রাস্তার পাশে স্বজনহীন কাউকে শরীরে ক্ষত নিয়ে পড়ে থাকতে দেখলেই ছুটে যান তারা। হাসপাতালেও যাদের ঠাঁই হয় না, সেই সব রোগীদের জন্য ব্যবস্থা করেন চিকিৎসা, খাবার আর পোশাকের। নয় বছর ধরে পরিচয় গোপন রেখে এ সেবা দিয়ে আসছিলেন পুলিশের সাত সদস্য।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2019, 05:56 AM
Updated : 25 Feb 2021, 08:23 AM

শেষ পর্যন্ত নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে তারা জানালেন এই মহৎ উদ্যোগ এগিয়ে নিতে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা; জানালেন অসহায় মানুষের পাশে থাকার আকুতি।

আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে ‘মানবিক পুলিশ ইউনিট’ গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান।

এতদিন নিজেদের উদ্যোগে এই সেবা দিয়ে আসছিলেন চট্টগ্রামের দামপাড়া বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালের সাত কনস্টেবল মো. শওকত হোসেন, মো. হান্নান, মো. মাঈনুদ্দীন, মো. মাহবুবুল আলম, মো, ইয়াছিন আরাফাত, মো. রবিউল হোসেন, মো. এমরান হোসেন।

মূলত কনস্টেবল শওকতের উদ্যোগেই ২০১১ সালে এ কাজে শামিল হয়েছিলেন তারা সাতজন। পরিচয় গোপন করে নিজেদের টাকায় তারা এ সেবা দিতেন। বিষয়টি নগর পুলিশের কর্মকর্তাদেরও নজরে ছিল না।

দামপাড়া পুলিশ লাইনসে বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে এই সাত পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

পথের মানুষ সেবা পাক

পথের ধারে পড়ে থাকা এক অসহায় মানুষের রোগে ভোগার কষ্ট দেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন কনস্টেবল শওকত। তারপর সেই যাত্রা চলছে নয় বছর ধরে। এখন যেন তা নেশায় পরিণত হয়েছে তার দলের সদস্যদের।

২০০৫ সালে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়ার পাঁচ বছর পর ঢাকা থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে যান শওকত। নার্সিং ও প্যারামেডিক ডিপ্লোমাধারী হওয়ায় পদায়ন হয় দামপাড়া পুলিশ হাসপাতালে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শওকত বলেন, “তখন আমার কাজ ছিল গুরুতর অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়, এক পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে রাস্তার পাশে এক মানসিক ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে দেখি। তার শরীরের একাংশে পচনে পোকা ধরে গেছে।”

সেই প্রতিবন্ধীর কষ্ট স্পর্শ করে শওকতকে। তাকে নিয়ে ভর্তি করে দেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। কিন্তু পরদিন গিয়ে দেখেন, হাসপাতালে রোগী নেই। 

“তাকে না পেয়ে ফিরে যাই সেই রাস্তায়, যেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। এরকম তিনজন রোগীকে আমি হাসপাতালে ভর্তি করেও পরে আবার সড়কের পাশে খুঁজে পাই। তখন ঠিক করি নিজেই চিকিৎসা করব।”

কিন্তু শওকতের সেই চেষ্টা সহজ ছিল না। যাদের সাহায্য করতে ছুটে যেতেন, তাদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখতে হয়েছে তাকে।

“এভাবে মানুষের মৃত্যু দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। সে তো আমার বাবা, ভাই কিংবা স্বজন হতে পারত। পথে থাকে বলে কী তারা সেবা পাবে না?”

শওকত বলেন, মেগট (শরীরের ক্ষতস্থানে পোকা ধরে যাওয়া) রোগীদের কাছ থেকে প্রচুর দুর্গন্ধ ছড়ায়। তারা নিজেরা চলাফেরা করতে পারে না। আবার তাদের আশেপাশেও কেউ যেতে চায় না।

“আমার মেগট রিপেয়ারিং কোর্স করা থাকায় নিজেই তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিই। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ফরেনসিক মর্গের ডাস্টবিনের পাশে বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী এক লোককে দেখতে পাই। সেই লোকের কোমর থেকে বাঁ পায়ের ক্ষতে পোকা বাসা বেঁধেছে। তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মাধ্যমে শুরু করি প্রথম কাজ।”

মেগট আক্রান্তরা চলাফেরা করতে পারেন না বলে যেখানে থাকেন, সেখানেই তারা মলমূত্র ত্যাগ করেন। তাদের পরিষ্কার করে কাপড়গুলো ফেলে দিতে হয়।

“প্রথমে নিজের পুরানো কাপড় নিয়ে ব্যরাকের সহকর্মীদের নিয়ে যেতাম ওই ব্যক্তিকে সেবা করার জন্য। একদিন পরপর গিয়ে তাকে সেবা করেছি চার মাস। মেগট সারিয়ে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে অপারেশন করে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলি। ওই সময় বদনা শাহ মাজারের এক ব্যক্তিকেও একইভাবে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম হই।”

এরপর আশপাশের লোকজনকে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে এ ধরনের রোগী দেখলে ফোনে জানাতে বলেন শওকত। কিছু দিন পরপর ফোন পাওয়া শুরু হয়। বছরখানেকের মধ্যে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে নিজের টাকায় সেবা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে শওকতের জন্য।

তিনি তখন বিষয়টি জানান তার সহকর্মী কনস্টেবল মাঈনুদ্দিন, আনোয়ার ও মিরাজকে। তারা টাকা দেওয়ার পাশাপাশি শওকতের কাজে সহযোগিতা শুরু করেন। তাদের দেখে এগিয়ে আসেন রেজাউল ও আল আমিন।

এভাবে কাজ করতে করতে দুই বছরের মধ্যে মাঈনুদ্দীন ছাড়া অন্য সবাই চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে যান। কিন্তু দমে যাননি শওকত। তার পাশে এগিয়ে আসেন মো. হান্নান, মো. মাহবুবুল আলম, মো, ইয়াছিন আরাফাত, মো. রবিউল হোসেন, মো. এমরান হোসেন।

শওকত বলেন, তার সহকর্মীরা সবাই মানবিক পুলিশ সদস্য। নিজেদের পকেটের টাকায় তারা এগিয়ে যান অসহায় মানুষের সেবায়। নিজেদের প্রতি মাসের বেতন থেকে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে তুলে দেন এ কাজে। সহযোগিতা করেন সেবার কাজেও। 

সময় পেলেই অসহায়ের পাশে

পুলিশের চাকরি করে কীভাবে এ কাজ করে আসছিলেন শওকত?

তিনি জানালেন- সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে কাজ করার পর বাকি সময়টা তার হাতে থাকত। তাদের সাত জনের মধ্যে যাদের ২টা পর্যন্ত কাজ, তাদের নিয়ে বিকালে বের হয়ে পড়েন অসহায় রোগীদের সেবা দিতে।

নয় বছরে এভাবে অন্তত ৪০ জন রোগীকে সেবা দিয়েছেন জানিয়ে শওকত বলেন, “মেগট রিপেয়ার ট্রেনিং ছাড়া এসব রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। আর এই চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ওষুধ, খাবার, কাপড়- সবকিছুর ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হত।”

ওই ৪০ জন রোগীর মধ্যে ২০ জনের শরীরে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। বাকিরা মেগট সারার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। অনেক রোগী মারাও গেছেন।

শওকত বলেন, “এ কাজ করতে গিয়ে সবসময় পরিচয় গোপন রাখতে হয়েছে। যারা জানতো, তাদের অনেকে বিভিন্ন রকম কথাও বলেছে। কখনও কখনও সহকর্মীদের কাছ থেকেও শুনতে হয়েছে গঞ্জনা।

“সহকর্মীরা অনেক সময় বলেছে, পুলিশের চাকরি করি, রাস্তার মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়া তো আমাদের কাজ না। আবার কেউ কেউ বলেছে, এসব রোগীদের মাধ্যমে আমারাও আক্রান্ত হব। পরে ছড়িয়ে পড়বে অন্যদের মাঝে।”

সব কিছু মেনে নিয়েই নিজেদের কাজ চালিয়ে নিয়ে গেছেন সাত পুলিশ সদস্য। এ কাজে সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীদের প্রতি। বিভিন্ন জটিল রোগীর ক্ষেত্রে তারা পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছেন বলেও জানান।

অবশেষে প্রকাশ্যে

শতওকত বলেন, কে, কেমনভাবে এই কাজটি নেবে- সেটা তারা বুঝতে পারছিলেন না। মূলত কাজে বাধা আসতে পারে ভেবেই নিজেদের পরিচয় গোপন রেখেছেন এতদিন। কিন্তু এখন রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চাকরির পাশাপাশি অসহায় মানুষগুলোর সেবা দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়া অর্থ যোগানোও একটি বড় সদস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভায় নিজেদের এই কাজের কথা তুলে ধরে সহযোগিতার আর্জি জানান শওকতরা।

চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা সবার অগচোরে যে মানবিক কাজটি করে যাচ্ছে, সেটি শুনে আমি অভিভূত হয়েছি। এরকম আরও অনেকে কাজ করছে এবং করেছে। এসব কাজগুলোকে সমন্বিতভাবে করার জন্য ‘মানবিক পুলিশ ইউনিট’ গঠন করছি, যাতে আমরাও তাদের সুপারভিশন করতে পারি।”

তিনি জানান, সরকারি কাজের বাইরে গিয়ে যারা এসব মানবিক কাজ করতে চায়, তাদের সহযোগিতা করা হবে। পাশাপাশি এসব কাজে তহবিল গঠনের জন্য তিনি নিজেও এক লাখ টাকা দিয়েছেন।