লোকালয়ে হাতি: বাড়ছে উভয়মুখী ক্ষতি

বছরের এই সময়ে পাহাড়ের খাবার স্বল্পতা থাকায় পাকা ধানের টানে লোকালয়ে নেমে আসছে হাতির পাল, আর তাতে বাড়ছে মানুষ ও হাতির প্রাণহানি এবং ফসলের ক্ষতি।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Nov 2019, 10:16 AM
Updated : 25 Nov 2019, 01:30 PM

প্রাণী গবেষকরা বলেন, হাতির আচরণ সম্পর্কে না জানা এবং অতি উৎসাহে স্থানীয়রা কখনও কখনও হাতির চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা হাতিকে আতঙ্কিত করে তোলে, এতে ফসলের জমি, ঘরবাড়ি ও মানুষের ওপর আক্রোশ বাড়ে। ক্ষিপ্ত হাতির আক্রমণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।  

আর বিপরীতে হাতি ঠেকাতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতা হয় কোনো কোনো এলাকায়। ফাঁদে আটকে মারা পড়ছে হাতিও।

শনিবার বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব কধুরখীলের দারোগা বাড়ি বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদ সংলগ্ন সুপারি বাগানে অবস্থান নেয় নয়টি হাতির একটি পাল।

দিনভর উৎসুক স্থানীয়দের ভিড় ছিল ওই এলাকায়। সেখানে থাকা হাতিগুলো একাধিকবার পাশের ধানক্ষেতে নেমে এলেও পরে আবার বাগানে গিয়ে অবস্থান নেয়।

সাধারণত গভীর রাতে ও সকালের দিকে পথ চলে হাতি। ওই বাগানে আটকে পড়া হাতিগুলোও রোববার ভোরের দিকে ফিরতে শুরু করে নিজেদের গন্তব্য জ্যেষ্ঠপুরার পাহাড়ের দিকে।

ফেরার সময় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে হাতির পাল তাণ্ডব চালালে তিনজন নিহত হয়।

পাকা ধানের টানে

মূলত পাকা ধানের টানেই পাহাড় থেকে হাতির পাল লোকালয়ে নেমে আসে বলে স্থানীয় অধিবাসী, বন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা, মীরেরখিল, পদুয়াসহ কয়েকটি এলাকায় নিয়মিত হাতি নামে অগাস্টে এবং অক্টোবর-নভেম্বরে।

বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা পাহাড় ও জ্যেষ্ঠপুরা এবং আশেপাশের এলাকাতেও এই দুই সময়ে হাতি পাহাড় থেকে নেমে আসার প্রবণতা বেশি।

অগাস্টে আউশ ধান এবং নভেম্বের আমন ধান পাকার সময়। এই সময়টা হাতির উপদ্রব বেড়ে যায়।

সরফভাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অগাস্টে তিনটা হাতি নেমে আসে আমার এলাকায়। পরে বন বিভাগ, পুলিশ ও স্থানীয়রা মিলে সেগুলোকে পাহাড়ে পাঠানো হয়। ১৫ দিন আগে আবার দুইটা আসে ক্ষেত্রবাজারে।

“হাতির পাল ক্ষেতের ধান খায়। এমনকি গোলা ভেঙেও ধান খায়। যতটুকু খায় তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে। ক্ষেতের উপর দিয়ে হাতি চলে গেলে জমির বেশিরভাগ ধানই নষ্ট হয়ে যায়। হাতির অত্যাচারে আমাদের ইউনিয়নে প্রচুর জমি অনাবাদি পড়ে আছে।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পবিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দানেশ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাতির খাবার মূলত কলাগাছ, ঘাস ও অন্যগাছের পাতা। আমাদের বনভূমির পরিমাণ কমছে।

“পাশাপাশি বছরের এই সময়ে পাহাড়ে গাছপালার বৃদ্ধি কম হয়। যেহেতু হাতি ধানগাছ খায় তাই ধানক্ষেতে বেশি নামে। খাবারের স্বল্পতার কারণে তারা নেমে আসে। একারণে হিউম্যান-এলিফেন্ট কনফ্লিক্টও বাড়ছে।”

চুনতি বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের রেঞ্জ অফিসার মো. মনজুরুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাতির খাদ্য তালিকায় ধান আছে। শুধু আছে তাই না, পাকা ধান হাতির খুব পছন্দের খাবার।

পাহাড়ে খাবার সঙ্কটই হাতি নেমে আসার প্রধান কারণ হিসেবে মানতে নারাজ তিনি।

“পাহাড়ে খাবার সঙ্কটের কথাটা মোটাদাগে বললেই হবে না। তাহলে বছরের এই নির্দিষ্ট সময়টাতে পাহাড় থেকে হাতির নেমে আসে কেন? এই প্রবণতা প্রমাণ করে মূলত ধানের টানেই তারা আসে।”

একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতির দৈনিক খাবারের চাহিদা ২০০ থেকে ২৫০ কেজি। যার মধ্যে বেশিরভাগই কলাপাতা, ঘাস ও গাছপালা বলে জানান এই বন কর্মকর্তা।

কধুরখীল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিচ বলেন, “আমাদের এলাকায় ওই হাতির পাল ধান ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এরা দিনের বেলায় বাগানে থেকে গাছপালা খেয়েছে। রাতে বাগান থেকে বের হয়ে চলতে শুরু করে। পরে সকালে জ্যেষ্ঠপুরার পাহাড়ে উঠে যায়।”

হাতির আতঙ্কে বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব কধুরখীলের বাসিন্দারা

বাচ্চা থাকায় বেশি ক্ষিপ্ত

বোয়ালখালীর সেই নয় সদস্যের হাতির পালটি গভীর রাতে দুই দলে ভাগ হয়ে ওই এলাকা থেকে বেরিয়ে পরে। চার সদস্যের একটি দল কধুরখীল, চরণদ্বীপ হয়ে ফতেয়ারখীলের দিকে এবং পাঁচটি হাতির অন্য দলটি সৈয়দপুর, খরণদ্বীপ হয়ে ফতেয়ারখীলের দিকে রওনা হয়।

প্রথম দলটি মধ্যম কধুরখীলে একজনকে এবং অন্য পালটি খরণদ্বীপ ও সৈয়দপুরে অন্য দুজনকে আছড়ে ও পায়ের চাপায় মেরে ফেলে।

চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বখতিয়ার নুর সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতি ফিরে যাওয়ার পথ চায়। তারা যে পথে আসে সেপথেই আবার ফেরত যায়।

“পথ খোলা থাকলে তারা কাউকে বিরক্ত করে না। চলার পথে বাধা আসলে তারা আতঙ্কিত হয় এবং পরে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।”

চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের রেঞ্জ অফিসার মো. মনজুরুল আলম বলেন, নির্দিষ্ট পথে চলাচল করে বলেই চলার পথে প্রতিবন্ধকতা থাকলে তারা ক্ষিপ্ত হয়।

“সঙ্গে বাচ্চা থাকলে হাতি ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে। উৎসুক লোকজন গত শনিবার দিনভর হাতিগুলোর আশেপাশে ভিড় করেছিল।”

হাতি লোকালয়ে নামলে কখনোই উত্ত্যক্ত না করা এবং চলাচলের পথ উন্মুক্ত রাখার পরামর্শ দেন এই বন কর্মকর্তা।

উভয়মুখী ক্ষতি

লোকালয়ে হাতি আসায় ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। আবার হাতিও মরছে।

১৮ অগাস্ট আনোয়ার উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের তৈলারদ্বীপে আবদুল মোতালেব নামের একজনকে হাতি আছড়ে ফেললে তার মৃত্যু হয়।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে বোয়ালখালী উপজেলার জঙ্গল আমুচিয়ার করলডেঙ্গা পাহাড়ের পাদদেশে কৃষি কাজ করার সময় হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান উত্তর করলডেঙ্গার বাসিন্দা স্থানীয় আব্দুল আলম (৫৭)।

চলতি বছরের ২৩ মার্চ রাতে সরফভাটা ইউনিয়নের জঙ্গল সরফভাটা এলাকায় হাতির জন্য পাতা বৈদ্যুতিক ফাঁদে বিদ্যুতায়িত হয়ে সাহাব উদ্দিন (২৪) নামের এক বাক প্রতিবন্ধীর মৃত্যু হয়।

গত ১৮ নভেম্বর রাতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের নারিশ্চা জয়নগর এলাকায় বৈদ্যুতিক ফাঁদে জড়িয়ে ৮-১০ বছর বয়সী প্রায় তিন টন ওজনের একটি হাতি মারা যায়। এ ঘটনায় বন বিট কর্মকর্তা বাদী হয়ে চারজনের বিরুদ্ধে মামলাও করেন।

পদুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম কবির তালুকদার বলেন, হাতির কারণে ফসলের ক্ষতি হয় বলে মানুষ বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতে। এতে একটি হাতি মারা যায়।