চট্টগ্রামে হিযবুতের নেতৃত্বে ‘শিবিরের সাবেকরা’

চট্টগ্রামে তিনভাগ হয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর, আর তার নেতৃত্বে রয়েছেন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতারা।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2019, 01:58 PM
Updated : 23 Nov 2019, 05:00 PM

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারের শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়ে সদস্য সংগ্রহ করছে সংগঠনটি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ এক নেতাসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে পুলিশ।

শুক্রবার দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সিএমপির দক্ষিণ জোন নগরীর আন্দরিকল্লা শাহী জামে মসজিদ, চান্দগাঁও আবাসিক ও বায়েজিদ এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গ্রেপ্তাররা হলেন- ওয়ালিদ ইবনে নাজিম (১৮), ইমতিয়াজ ইমাইল (২৫), আবদুল্লাহ আল মাহফুজ (৩০), আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলম (৩৯), নাছির উদ্দিন চৌধুরী (২২০, নাজমুল হুদা (২৭), লোকমান গণি (২৯), মো. করিম (২৭), আবদুল্লাহ আল মুনিম (২২), কামরুল হাসান রানা (২০), আরিফুল ইসলাম (২০), আজিম উদ্দিন (৩১), আজিমুল হুদা (২৪), ফারহান বিন ফরিদ (২৩) ও মো. সম্রাট (২২)।

তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ প্রচারপত্র, নগদ দুই লাখ ৮২ হাজার টাকা, দুটি ল্যাপটপ, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও ট্রেনিং ম্যানুয়ালসহ বিভিন্ন সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়।

গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে রিমান্ডেও পেয়েছে পুলিশ।

পুলিশ বলছে, চট্টগ্রামে হিযবুতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা গ্রেপ্তার আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলম (৩৯) আগে ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।

তার নেতৃত্বে তিন ভাগে নগরীতে কর্মকতাণ্ড পরিচালনা করে আসছে হিযবুত তাহরীর। প্রতিটি ভাগে অন্তত ২৫ জন করে সক্রিয় সদস্য আছে।

এক ভাগে নোভারটিস ফার্মাসিটিক্যাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের টেরিটরি ব্যবস্থাপক গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ, অপর দুই অংশের নেতৃত্বে নৌ বাহিনী স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক তাহমিদ সুফিয়ান ওরফে সবুজ এবং চট্টগ্রাম ডিজিটাল স্কুল নামে একটি স্কুলের পরিচালক তাহমিদ সুফিয়ান।   

অভিযানের নেতৃত্বে থাকা নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হিযবুত নেতাদের অনেকেই এক সময়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে।

“গ্রেপ্তার এরশাদ ও পলাতক তাহমিদ সুফিয়ান এক সময় শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।”

পুলিশ কর্মকর্তা রউফ বলেন, “হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও তারা গোপনে কাজ করছে। সেজন্য আমরা চারমাস ধরে সংগঠনটির ওপর নজরদারি করছিলাম।

“তাদের কোনো সাংগঠনিক পদবী নেই। শুধু একজন নেতা থাকে। এক ভাগের কর্মীরা তাদের নেতাকে চেনে। অন্য পক্ষের সদস্যরা অন্য চেনে না। জঙ্গি সংগঠনের মতো তারাও মূলত ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে সংগঠন পরিচালনা করে। কোনো কর্মী অন্যদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে না।”

রউফ বলেন, “হিযবুত মূলত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী, যাদের মধ্যে নেতৃত্ব গুণ আছে এবং বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত আছে তাদের টার্গেট করে। নেতৃত্বস্থানীয় অনেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারের শিক্ষক হিসেবে কাজ করে। সেখানে তারা ‘ফলোয়ার’ তৈরি করে কোমলমতী শিক্ষার্থীদের সংগঠনের কাজে জড়িয়ে নিচ্ছে।

ছাত্রশিবিরের আদলে দাওয়াতী কার্যক্রম

মামলার বাদি কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ায় হিযবুত সদস্যরা প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম চালাতে পারে না। তারা ছাত্রশিবিরের মতো নিজেদের কর্মকাণ্ড চালায়।

শিবিরের মতো করে তারাও ‘দাওয়াতী’ কার্যক্রম চালিয়ে কর্মী সংগ্রহ করে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমে তারা নামাজ পড়া এবং ধর্মীয় আলোচনার দাওয়াত দেয়। এর মাধ্যমে তাদের দাওয়াতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও যুবকরা।

“ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে আমাদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নামাজ ও ধর্মীয় বিষয়ে সম্পৃক্ত হলে বাধা দেন না। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তারা সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করে।”

অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রউফ বলেন, সংগঠনের নবীন কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ক্লাস করতে হয়। প্রতি সপ্তাহে একদিন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা করে প্রশিক্ষণ ক্লাস করতে হয়।

শুক্রবার চান্দগাঁও এলাকায় মাহফুজের বাসা থেকে শীর্ষ নেতা এরশাদুলসহ যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তারা সবাই প্রশিক্ষণ ক্লাসে অংশ নিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি। শিক্ষার্থীরা বাসায় কোচিংয়ে ক্লাস করতে যাওয়ার কথা বলে তাতে অংশ নেয়।

তিনি বলেন, “চার মাস আগে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পোস্টর লাগিয়েছিল হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা। ওইসব এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তাদের শনাক্ত করি, পাশাপাশি এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করি। এছাড়াও যেসব মসজিদে তারা লিফলেট বিতরণ করে সেসব এলাকায়ও গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় নিয়ে আসি।

“এর অংশ হিসেবে শুক্রবার নগরীর আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে লিফলেট বিতরণের সময় ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ ইবনে নাজিম ও ইমতিয়াজ ইসমাইল নামে দুইজনকে আটক করি এবং তাদের তথ্যে নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে আব্দুল্লাহ আল মাহফুজের বাসায় বৈঠকের সময় চট্টগ্রামের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলমসহ মোট ১১ জনকে আটক করা হয়।”

এছাড়াও পাঁচলাইশ থানার আল আমিন হাউজিং এলাকা থেকে ফরহাদ বিন ফরিদ ওরফে রাফি (২৩) নামে একজনকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে বই লিফলেট উদ্ধার করা হয়। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মোজাফ্ফর নগর এলাকা থেকে সম্রাট নামে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠন হিসেবে পরিচিত হিযবুত তাহরীরের প্রতিষ্ঠা ১৯৫৩ সালে জেরুজালেমে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতার নাম তকিউদ্দিন আল নাভানী। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণকারী এই সংগঠনটি ইসলামী খিলাফত কায়েমে বিশ্বাসী। বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে এই সংগঠন সক্রিয় রয়েছে।

বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের তৎপরতা শুরু হয় ২০০০ সালের কিছু পরে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

তবে হিযবুতের প্রচার কার্যক্রম বলছে, নিষিদ্ধ হওয়ার ১০ বছর পরও দলীয় কার্যক্রম গোপনে হলেও ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, হিযবুত তাহরীর তাদের কার্যক্রমকে জঙ্গি কার্যক্রম নয় বলে দাবি করলেও তারা প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন।

সেজন্য তারা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে উস্কানি দিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালায়। পাশাপাশি তারা সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিরও উদ্যোগ নিয়েছে।