কালুরঘাটে নতুন সেতু দেখা হল না বাদলের

কালুরঘাটে নতুন সেতুর কাজ শুরু না হলে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসেছে সেতু নির্মাণের ঘোষণা। কিন্তু সেই সেতুই দেখে যেতে পারলেন না জাসদ নেতা সংসদ সদস্য মইন ‍উদ্দীন খান বাদল।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2019, 09:25 AM
Updated : 7 Nov 2019, 10:53 AM

বৃহস্পতিবার ভোরে ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৬৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিক।

মৃত্যুর পর বাদলের এই ‘শেষ ইচ্ছা’র কথা চট্টগ্রামে তার রাজনৈতিক বন্ধু-প্রতিপক্ষ এমনকি সাধারণ মানুষের আলোচনায়।

সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক জানানোর পাশাপাশি এই মুক্তিযোদ্ধার শেষ ইচ্ছা পূরণে কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাজ অবিলম্বে শুরুর বিষয়টিও এসেছে।

কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার বিষয়টি গত ৮ অক্টোবর বায়েজিদ সবুজ উদ্যানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন সাংসদ বাদল।

এরপর ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামে সড়ক ভবনে এক অনুষ্ঠানে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কালুরঘাটে পাশাপাশি রেল ও সড়ক দুটি সেতু হবে।

ওবায়দুল কাদেরের সেই বক্তব্যের ভিডিও বাদলের ফেসবুক পেইজ থেকে শেয়ারও করা হয়। এর ১০ দিনের মাথায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন তিনি।

বন্ধুর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, “শেষ একটা ইচ্ছা ছিল তার- কালুরঘাট সেতু। উনিই আমাকে এটার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান।

“প্রধানমন্ত্রী আমার সামনে বলেছেন- আপনার ব্রিজ আমি করে দেব। ইনশাল্লাহ্ ব্রিজ হবে। বাদল ব্রিজের জন্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিল। ব্রিজের কাজ করতে করতে সে দুনিয়া থেকে চলে গেল।”

নগরীর সাথে বোয়ালখালী উপজেলার সংযোগ স্থাপনকারী বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতুটি ৮৯ বছরের পুরনো।

এই সেতুর স্থলে একটি নতুন সেতুর দাবিতে সংসদে সোচ্চার ছিলেন বাদল। সেতু নির্মাণের দাবিতে আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে এবং বিভিন্ন সময় নানা বক্তব্য দিয়ে তিনি নিজের ক্ষোভ-আক্ষেপের কথাও জানান।

৮ অক্টোবর বায়েজিদ সবুজ উদ্যান উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে বাদল বলেন, “কালুরঘাট নিয়ে বলতে বলতে আমার গলা বন্ধ হয়ে গেছে। নেত্রী ডেকেছিলেন, আমরা দুজনই গিয়েছিলাম। নেত্রী বললেন- আমি করব, করব, করব। আমি বললাম- আমি এটা বলতে পারব না, আমার কথা মানুষ বিশ্বাসও করে না। নেত্রী বললেন, মোশাররফ সাহেব আপনি যান। আপনি গিয়ে বলেন এই ব্রিজটা আমি করে দিব।”

গণপূর্তের পরিকল্পনায় ক্ষোভ জানিয়ে বাদল বলেছিলেন, “কেন কালুরঘাট সেতু প্রায়েরিটি কনর্সান পেল না। বাংলাদেশে এমন ব্রিজও হয়েছে যেটার উপর দিয়ে গরুর গাড়িও যায় না। এটাতে চোখ পড়ল না কেন? ভেরি ইমর্পটেন্ট স্ট্র্যাটেজিক ব্রিজ। আমাদের সমস্যা দক্ষিণ দিক থেকে। রোহিঙ্গারা মুখ ভেঙচায়। মিয়ানমার মুখ ভেঙচায়। এই ব্রিজটা থাকলে আওয়ার ফোর্সেস ক্যান স্মুথলি মুভ। কেন এটা পরিকল্পনায় আসে না?”

২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বাদল বলেছিলেন, “দল সরকারে গেলে আর আমি জয়ী হতে পারলে এক বছরের মধ্যে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করব। না হলে আমি পদত্যাগ করব।”

চলতি বছরের ১০ অগাস্ট চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় বাদল বলেন, “আমি সরকারি জোটের এমপি. ব্রিজের জন্য যদি আমাকে আওয়ামী লীগ করতে হয়, প্রয়োজনে সেটাও করতে রাজি।... প্রধানমন্ত্রীকে করজোড়ে বলেছি, প্রতিদিন ৫০ হাজার মানুষ আমার মাকে গালি দেয়। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি ব্রিজটা করে দেন।”

সেই নির্বাচনে বাদলের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান বৃহস্পতিবার ফেইসবুকে স্ট্যাটাসে লেখেন, “ডিসেম্বর ২০১৯ এর মধ্যে কালুরঘাট ব্রিজের কাজ শুরু না হলে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সরকারের কাছে দাবি অনতিবিলম্বে এই ব্রিজের কাজ শুরু করুন। অন্তত উনার বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।”

সেতুর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মোমিন বলেন, “আমরা উনাকে বলেছিলাম আপনি সংসদ থেকে চলে এলে জনগণের প্রাণের দাবি কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কথা সংসদে কে বলবে? প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেন দরবার কে করবে?

“ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু সেতুর নির্মাণ আর দেখে যেতে পারলেন না গণমানুষের প্রিয় নেতা বাদল ভাই। দাবি আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার, জাতীয় সংসদে জনগণের কথা বলার সেই মানুষটিই চলে গেলেন।”

আব্দুল মোমিন বলেন, “ডিসেম্বরে আর সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে হল না উনাকে। এই পৃথিবী থেকেই উনি পদত্যাগ করে চলে গেলেন।”

১৯৩০ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ৭০০ গজ দীর্ঘ রেল সেতুটি ১৯৫৮ সালে সব ধরনের যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

৮৯ বছর বয়সী সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলছে কয়েক হাজার যানবাহন ও কয়েক জোড়া ট্রেন। এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার লোক পারাপার হয়।

চট্টগ্রাম শহর থেকে বোয়ালখালী উপজেলায় পৌঁছাতে যেখানে সময় লাগার কথা ৩০ থেকে ৪০ মিনিট, সেখানে একমুখী এ সেতু দিয়ে চলাচলে সময় লাগছে তিন থেকে চার ঘণ্টা।

এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারি রুটে চলাচল করে দুই জোড়া ট্রেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ চালু হলে তারও পথ হবে এই সেতু।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু ভেঙে গেলে কালুরঘাট সেতু হয়ে পড়ে নগরীর সাথে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয়টি উপজেলা ও কক্সবাজার, বান্দরবান জেলার যোগাযোগের অন্যতম রাস্তা।

স্থানীয়দের দাবি, ২০১০ সালে তৃতীয় শাহ আমানত সেতুর উদ্বোধনের আগ পর্যন্ত কালুরঘাট সেতু দিয়ে ভারী যান চলাচলের কারণে সেতুটি আরও নাজুক হয়ে পড়ে।

২০০১ সালে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় এ সেতুটি বন্ধ রেখে সংস্কার কাজ করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সেতুটিতে ছোটখাট সংস্কার কাজ করে যান চলাচলের উপযোগী করে রাখা হয়।