ছেলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর একদিন আগে ফেইসবুকে দেওয়া পোস্টে হত্যাকাণ্ডের ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুমের জামিন পাওয়া নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
শনিবার দেওয়া ওই ফেসবুক স্ট্যাটাসে পরিবার জীবন শঙ্কায় আছে বলেও উল্লেখ করেন সুদীপ্তর বাবা।
আর তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই বলছে তাদের তদন্ত এখনও চলমান।
সুদীপ্ত হত্যা মামলায় লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম ৪ জুলাই গ্রেপ্তার হলেও উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৫ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান।
এ বিষয়ে সুদীপ্তর বাবা মেঘনাথ টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচার পাওয়া যাবে কিনা সেটা নিয়ে আমি সন্দেহ প্রকাশ করছি। কাল আমার ছেলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। খুব কষ্টের মধ্যে বেঁচে আছি। সাংবাদিকরা পক্ষে না থাকলে হয়ত এতটুকুও হতো না।”
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মেঘনাথ বিশ্বাস তার ফেইসবুক পোস্টে ছেলেকে ঘিরে নিজের স্মৃতি ও পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন।
‘সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে আমি আর আমার পরিবার আজ আমাদের জীবন নিয়ে শংকিত’ শিরোনামে লেখা ফেইসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, “আজ ৫ই অক্টোবর ২০১৭ সালের এই দিন শেষবারের মতো ছেলেটা আমাকে বাবা বলে ডেকেছিল। লক্ষ্মীপূজা ছিল। সকালে আমি বেরুচ্ছিলাম, এই সময় খুব সংকোচের সাথে বাবা ডেকে ছেলেটা আমার কাছে ২০টা টাকা চাইল। প্রায়ই চাইত। আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম। আর কত দেবো তোকে? পকেটে ভাংতি ৩০ টা টাকা ছিল, তাই দিলাম। ছেলেটার মুখে সেই আমার শেষ বাবা ডাক শুনা। রাগ করি আর যাই করি, তার জন্য আমার হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা ছিল। ছেলেটা ও সেটা বুঝত, তারপর ৬ ই অক্টোবর আমার ছেলেকে হারানো মানে আমার সুখ-শান্তি, আশা-ভরসা, সর্বস্ব হারানোর দিন।”
“শুধুমাত্র প্রতিবাদের কারণে লালখান বাজারের এক বড় ভাইয়ের নিদের্শে একদল তারই পালিত হায়না লোহার রড, হকিস্টিক, চাপাতিসহ অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে। শরীরে এমন কোন জায়গা নাই যেখানে তাকে নির্মম অমানুষিকভাবে আঘাত করা হয়নি। ডান হাতটা ভাঙ্গা ছিল। সে কারণে একটুও প্রতিরোধ করতে পারেনি। তার আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়েছিল কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। এখন কেউ এগিয়ে আসে না। মানুষকে এখন বড় ভয়।”
সুদীপ্ত হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ করে ছিল চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ওই সময় তিনি সুদীপ্ত হত্যার বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন।
ছেলের মৃত্যুর পর সুদীপ্ত বিশ্বাস রুবেলের বাবা-মার আহাজারি
২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর সকালে দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে। এ ঘটনায় সুদীপ্তর বাবা বাদী হয়ে সদরঘাট থানায় অজ্ঞাত সাত-আটজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
হত্যাকাণ্ডের পর মহানগর ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছিলেন, বিগত কয়েক দশক ধরে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থকরা থাকলেও কয়েক বছর ধরে তার বিপরীতে একটি অংশ দাঁড়িয়েছে, যাদের একাংশের নেতৃত্বে আছেন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম।
এই মাসুমের অনুসারীরাই সুদীপ্তকে পিটিয়ে মেরেছে বলে অভিযোগ করে আসছে নগর ছাত্রলীগের একাংশ। এই হত্যা মামলায় বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া সবাই মাসুমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
আর মাসুম সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি থাকার সময়ে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থক হিসেবে পরিচিতি হলেও ২০১৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর তিনি মেয়র আ জ ম নাছিরের বলয়ে চলে আসেন। মাঝে তিনি সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফসারুল আমীনের অনুসারী হিসেবে বলেও পরিচয় দিতেন।
হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত পিবিআইকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়। গত বছরের নভেম্বর মাসে পিবিআই মামলার তদন্ত কাজ শুরু করে।
মামলাটি পিবিআই তদন্ত শুরু করার গ্রেপ্তার করে আরও কয়েকজনকে। তার মধ্যে গত ১২ জুলাই মিজান নামে গ্রেপ্তার একজন তার জবানবন্দিতে দিদারুল আলম মাসুমের নাম উল্লেখ করে বলে জানা যায়।
এর মধ্যে ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এফ কবির মানিক গত ২২ জুলাই দিদারুল আলম মাসুমের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৩১ জুলাই মাসুমের দুটি অস্ত্রের নিবন্ধন বাতিল করে আদেশ জারি করে মন্ত্রণালয়। ৩ জুলাই বিকালে মাসুম নিজে গিয়ে তার নিবন্ধন বাতিল করা অস্ত্রগুলো খুলশী থানায় জমা দিয়েছিলেন।
এর পরদিন ৪ জুলাই ঢাকার বনানী থেকে মাসুমকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। ১৫ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ছাড়া পান মাসুম।
নিরাপত্তাহীনতায় পরিবার
মাসুমের জামিন পাওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত করে কারও নাম উল্লেখ না করে ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুদীপ্তর বাবা মেঘনাথ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের লালখানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম
মেঘনাথ আরও লিখেছেন, “সকালে আমৃত্যু পুত্রশোক ধারণ করে ধুকে-ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া আমার স্ত্রী নেতার বেরিয়ে আসার কথাটা শুনে হতাশায় দুঃখে বেদনায় কাঁদছিল। বললাম, কাঁদছ কেন? এক এক দেশে এক এক বাও, যে দেশে যে রীতি সেটাই তো হবে। লোকটা ক্ষমতাবান। ক্ষমতার বলয় এমন যে, সেখানে বিচারের বানী পৌঁছতে পারে না। বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদে। নেতা বের হবেন- এটা আগেই জানতাম। দুঃখ পাওয়ার কিছু নাই। শুধু যন্ত্রণা হয় যখন ফেসবুকে হঠাৎ ভিডিওতে ধারণকৃত আমার ছেলেকে নির্মম পিটানো অবস্থায় মা মা আর্তনাদ আর কান্না আমার কানে অবিরাম অনুরনিত হয়ে আমাকে নিঃশেষ করে দিতে থাকে।”
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সন্তোষ চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মামলাটি তারা ভালোভাবে তদন্ত করছেন।
“ভালো কিছু করতে হলে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করতে হয়। তড়িঘড়ি করে সুন্দর ফল পাওয়া যায় না। চার্জশিট জমা দিলেই যে বিচার হয়ে গেল তা তো নয়। তদন্ত শেষে আশা করি ভালো কিছু উপহার দিতে পারব।”
সুদীপ্ত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর দিদাদুল আলম মাসুম রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মামলা তদন্তাধীন থাকার কারণ দেখিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান আইও সন্তোষ চাকমা।