রোহিঙ্গাদের ভোটার করতেন ‘ইসির অস্থায়ী কর্মী’

আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এক অস্থায়ী কর্মী জানতেন চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সার্ভারের পাসওয়ার্ড, আর তা ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হতো।

মিন্টু চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2019, 03:55 PM
Updated : 20 Sept 2019, 04:00 PM

মোস্তফা ফারুক নামের এই অস্থায়ী কর্মীকে অনিয়মের অভিযোগে তিন বছর আগে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও চট্টগ্রামের নির্বাচন কার্যালয়গুলোতে তার অবাধ যাতায়াত ছিল।

এমনকি চট্টগ্রামের সব থানা ও উপজেলার পাশাপাশি কক্সবাজার এবং বান্দরবান নির্বাচন কমিশনের সার্ভারের প্রবেশাধিকারও মোস্তফা ফারুকের কাছে ছিল বলে তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এর আগে গ্রেপ্তার নির্বাচন অফিসের কর্মী জয়নাল আবেদিনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা কীভাবে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করে সে বিষয়ে তথ্য দিয়েছে।

“মোস্তফা দীর্ঘদিন ধরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন অফিসের বিভিন্ন উপজেলায় টেকনিক্যাল সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে আসছে। ২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত সে কোতয়ালী থানা অফিসের অধীনে অস্থায়ীভাবে কাজ করত। পরেও বিভিন্ন সময়েও সে কাজ করেছে। চট্টগ্রামের ছয়টি থানা কার্যালয়ের সার্ভারে তার অবাধ প্রবেশ ছিল।”

মোস্তফাকে এবছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, আনোয়ারা, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ‘টেকনিক্যাল সাপোর্ট’ হিসেবে জেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ২ সেপ্টেম্বর তাকে বোয়ালখালীতে নিয়োগের আদেশ হয়।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভোটার করার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার কথা জানাজানি হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের কর্তারা বলছেন, তাকে চলতি মাসের শুরুতে বাদ দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অভিযোগে গত সোমবার চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিন ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার মোস্তফা ফারুককে আটক করা হয়। শুক্রবার একই মামলায় তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।

২০১৪ সালে চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের চুরি যাওয়া চারটি ল্যাপটপের একটির সন্ধান মিলেছে মোস্তফা ফারুকের বাসায়। এসব তথ্য আসার পর এই চক্রে জড়িত অন্যদের সন্ধানে মাঠে নেমেছেন তারা।

নিবার্চন কমিশন কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি উপজেলা ও থানা নির্বাচন অফিসের জন্য পৃথক সার্ভার স্টেশন আছে। সেখানকার কর্মকর্তারা একজন ভোটারের সব রকমের তথ্য সংগ্রহের পর ডেটাবেইজ তৈরি করে মূল সার্ভারে সেসব তথ্য দেওয়ার পর চূড়ান্তভাবে ভোটার তৈরি করা হয়। প্রত্যেক উপজেলা ও থানা সার্ভারের জন্য পৃথক পাসওয়ার্ড থাকে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তরা সেটি সংরক্ষণ করে থাকেন।

কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তা রাজেশ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন কমিশন অফিসে কাজ করার কারণে এবং ‘টেকনিক্যালি ইফিশিয়েন্ট’ হওয়ায় মোস্তফা ফারুক দ্রুতই সার্ভারে প্রবেশের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে ফেলে।

তিনি বলেন, এ চক্রের সদস্য গ্রেপ্তার জয়নাল দালালের মাধ্যমে পাওয়া রোহিঙ্গাদের তথ্যের সঙ্গে ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট যুক্ত করে ফাইল তৈরি করে নিত।এরকম ২০-২৫টি ফাইল জড়ো হলে সেগুলো মূল সার্ভারে সংযুক্ত করে ভোটার হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করতে পেনড্রাইভের মাধ্যমে অথবা অন্য উপায়ে মোস্তফাকে দিত। মোস্তফা সার্ভারে ঢুকে তাদের ভোটার করতো।

এবিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসেইন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চক্রটি শুধু ছয়টি নয় চট্টগ্রামের প্রতিটি উপজেলা ও থানার সার্ভারে প্রবেশ করতে পারত বলে আমরা জেনেছি। এছাড়া চট্টগ্রামে বসে তারা কক্সবাজার বা বন্দরবানের সার্ভারেও ঢুকে ভোটার করে নিতে পারত।

সার্ভারে প্রবেশ সংরক্ষিত থাকার পরও একজন টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ কীভাবে সেখানে ঢুকতে পারতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এসব কর্মীদের অনেকেই ২০০৭-০৮ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের অনেকের সাথে যোগাযোগের কারণে অনেকেই হয়তো এক্সেস করতে পেরেছে।”

তবে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার জালিয়াতির কথা জানাজানি হবার পর সার্ভারে প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা হবে বলে জানান জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “এখন থেকে উপজেলা বা থানা নির্বাচন অফিসারের উপস্থিতি ছাড়া আর কেউ সার্ভারে এক্সেস করতে পারবেন না। এর পাসওয়ার্ডও থাকবে তার কাছে।তিনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট না দিলে সেখানে প্রবেশ এবং তথ্য প্রদানের কাজটি করা যাবে না।”

মোস্তফা ফারুককে ‘অফিসের জন্য হুমকিস্বরূপ’ মন্তব্য করে ২০১৬ সালে কোতোয়ালী থানা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগকে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন। সে প্রেক্ষিতে স্মার্টকার্ড প্রকল্প (আইডিইএ) থেকে মোস্তফা ফারুককে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

এদিকে নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানায়, চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার পরও মোস্তফা ফারুকের আনাগোনা ছিল চট্টগ্রাম নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়।পাশাপাশি বিভিন্ন নির্বাচন কর্মকর্তা, কর্মচারি কারিগরীর ত্রুটি সারিয়ে নিতেন তার মাধ্যমে।

বৃহস্পতিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নেওয়ার পর গ্রেপ্তার করা হয় মোস্তফা ফারুককে। তার কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়ার কথা জানায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এছাড়া তার কাছ থেকে দুটি ল্যাপটপ, তিনটি সিগনেচার প্যাড, মডেম এবং ভোটার তালিকা লেমিনেটিং করার কাজ পাওয়া যায়।

উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপের মধ্যে একটি হল নির্বাচন কমিশনের চুরি যাওয়া চারটি ল্যাপটপের একটি।