৫০-৬০ হাজার টাকায় রোহিঙ্গাদের এনআইডি করে দেন জয়নাল: পুলিশ

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হাতে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তুলে দিতে কাজ করছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের একটি চক্র। আর প্রতিটি এনআইডির জন্য রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৫০-৬০ হাজার টাকা।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2019, 01:32 PM
Updated : 11 Dec 2019, 10:08 AM

ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তার অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে পুলিশ।

জয়নালের কাছ থেকে চক্রটির আরও দুইজনের তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনে চাকরি করার সুবাদে জয়নাল সেখানকার বিভিন্ন তথ্য জানত। সেগুলো ব্যবহার করে সে রোহিঙ্গাদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে দিত। এর সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের অধীনে আগে কাজ করা দুই ডেটা এন্ট্রি অপারেটর জড়িত আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।”

সম্প্রতি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির অভিযোগে দুই দালালকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাতে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জয়নাল আবেদীনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

এসময় তার কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ উদ্ধার এবং তার বন্ধু বিজয় দাশ ও তার বোন সীমা দাশকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ ঘটনায় নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের পক্ষে ডবলমুরিং থানার নির্বাচন কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা বাদি হয়ে জয়নালের সাথে গ্রেপ্তার দুইজনসহ মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মামলা করেন।

ভোরে মামলা হওয়ার পর দুপুরেই চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কোতোয়ালী থানা পুলিশকে জয়নাল জানিয়েছেন, ২০০৪ সালে তিনি অফিস সহায়ক হিসেবে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্প শুরু হলে তিনি বিভিন্ন কাজ রপ্ত করে নেন। ওই সময় তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে ঢুকে তথ্য পরিবর্তন কাজও শিখে নেন।

ওসি মহসিন বলেন, “ওই সময় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম, জন্ম তারিখসহ ছোটখাটো সংশোধনগুলো করে দিত সে। পরে রোহিঙ্গাদের ভোটার করে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়ার কাজ শুরু করে।”

“জয়নাল জানিয়েছে, চাকরির সুবাদে ঢাকায় জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের অধীনে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া সাগর ও সত্য সুন্দর নামের দুই ব্যক্তির সাথে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয়ের সূত্রে সে সাগরের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকায় একটি ল্যাপটপ কেনে।”

কোতোয়ালী থানায় হওয়া মামলায় বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম অফিস থেকে তিনি ডিএসএলআর ক্যামেরা, ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাড প্রতি শুক্র, শনিবারসহ বন্ধের দিনগুলোতে গোপনে তার বাসায় নিয়ে যেতেন। বাসায় বসে সে ল্যাপটপের সাথে সেসব সরঞ্জাম জুড়ে তথ্য তৈরি (ডাটা ক্রিয়েট) করে মেইলে ঢাকায় সাগরের কাছে পাঠাতেন।

সাগর নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে অবৈধভাবে ঢুকে করে তথ্য আপলোডসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রিন্ট কপি এসএ পরিবহনের মাধ্যমে জয়নালের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। প্রতিটি পরিচয়পত্র তৈরির জন্য জয়নাল রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে নিতেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জয়নালের মামা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে উচ্চপদে ছিলেন। তার মাধ্যমে জয়নালের পরিবারের সদস্যসহ ১৬ জন স্বজন নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন পদে চাকরি নিয়েছেন।

“অফিসে উগ্র আচরণের কারণে সে অন্তত ১০ বার চট্টগ্রাম নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শাস্তিমূলক বদলি হয়েছে। তবে বিভিন্নভাবে সে আবার চট্টগ্রামে চলে আসত। গত বছরের জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে কর্মরত আছে,” বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

তিনি আরও বলেন, জয়নাল নিজে ও স্বজনরা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে চাকরি করায় তার কাছে রোহিঙ্গাদের তথ্য আসত। আর সেসব তথ্যের ভিত্তিতে জয়নাল ৫০-৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দিতেন।

শনাক্ত হয়নি ল্যাপটপের উৎস

চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের কাজের পর কিছু ল্যাপটপ নিলামে বিক্রি করা হয়েছিল; কিছু ল্যাপটপ বিভিন্ন সময়ে খোয়াও গেছে। সেগুলোর মধ্যে কোনো ল্যাপটপ জয়নাল সংগ্রহ করেছেন তা তারা নিশ্চিত হতে পারেননি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিএমপি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বলেন, “সবেমাত্র আমরা মামলাটির নথিপত্র কোতোয়ালী থানা থেকে নিয়েছি। মামলাটি নিবিড় তদন্তের জন্য গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে। তাদের হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেছি।

“জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বলা যাবে কিভাবে কোথা থেকে সে (জয়নাল) ল্যাপটপ সংগ্রহ করেছে, সাগর ও সত্য সুন্দরের সাথে তার কিভাবে সম্পর্ক হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে।”

তাদের পাশাপাশি অন্য কারা জড়িত আছে সবকিছু নিয়ে অনুসন্ধান করা হবে বলে জানান পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া।