রোহিঙ্গা নারীর ভুয়া এনআইডির তথ্যও ইসির সার্ভারে

এক নারীর পাসপোর্ট আবেদনের তথ্য যাচাই করতে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে বড় ধরনের জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে পুলিশের তদন্তে।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2019, 06:42 AM
Updated : 4 Sept 2019, 01:04 PM

পুলিশ আর নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, রমজান বিবি নামে ওই রোহিঙ্গা নারী লাকী নাম নিয়ে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে তৈরি করিয়েছেন ওই জাল জাতীয় পরিচয়পত্র। অথচ ওই ভুয়া পরিচয়পত্রের তথ্যও নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে।

যেভাবে ওই জালিয়াতি করা হয়েছে তা দেখে স্থানীয় নিবাচনী কর্মকর্তারাও বিস্মিত।

এ ঘটনায় রমজান বিবি ওরফে লাকী নামের ওই তরুণীর পাশাপাশি তাকে সহযোগিতার অভিযোগে আজিজুর রহমান নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করেছেন হাটহাজারি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আরিফুল ইসলাম।

লাকী ও তার ভাই হিসেবে পরিচয় দেওয়া আজিজকে ওই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার থেকে দুই দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।

গ্রেপ্তার লাকী পাসপোর্ট আবেদন ফরমে ঠিকানা লিখেছেন হাটহাজারি উপজেলার মীর্জাপুর ইউনিয়নের ওবায়দুল্লাহ নগর। বাবার নাম আব্দুর সালাম, মা শাহেদা বেগম। আজিজের ঠিকানা ও বাবা-মায়ের নামও এক।

চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, হাটহাজারিতে একটি চক্র রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করছে। আর তাদের অর্থ দিচ্ছে সৌদি আরবে থাকা রোহিঙ্গারা।

কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পাসপোর্ট আবেদনের তথ্য যাচাই করতে গিয়ে লাকী নামের কাউকে ওই ঠিকানায় না পাওয়ায় পুলিশের সন্দেহ হয়।

এদিকে লাকী তার স্মার্ট কার্ড তোলার জন্য আজিজকে সঙ্গে নিয়ে রোববার জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গেলে সেখানে তার হাতের পুরনো এনআইডিতে ১৭ ডিজিটের নম্বর দেখে নির্বাচন কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়।

উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আরিফুল ইসলামের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে খোঁজ করে দেখা যায় লাকীর পরিচয়পত্রের তথ্য সেখানে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু তথ্য মিলিয়ে বোঝা গেছে, সেটি তৈরি করা হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে।

সার্ভারে ওই জাতীয় পরিচয়পত্রের নিবন্ধন ফরম নম্বর লেখা আছে ৪১৮৬৬৬৩৬৮। ভোটার সিরিয়াল নম্বর-১৭৬১ ও ভোটার এরিয়া কোড মীর্জাপুর (২ নম্বর ওয়ার্ড) (১২৯০) । কিন্তু হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, ওই নম্বরের নিবন্ধন ফরম লাকীর নামে ইস্যু করা হয়নি। তার নামে কোনো কাগজপত্রও ওই কার্যালয়ে নেই।

আরিফুল ইসলাম পুলিশকে জানিয়েছেন, মীর্জাপুরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সর্বশেষ ভোটার সংখ্যা ছিল ১৭৬০। কিন্তু লাকীর ভোটার সিরিয়াল নম্বর ১৭৬১। নিবন্ধন ফরমের যে নম্বর সার্ভারে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই নম্বরের কোনো ফরম হাটহাজারি উপজেলার জন্য বরাদ্দ ছিল না।

নিবন্ধন ফরম বইগুলো হয় ১০০ পাতার। সেখানে এক সিরিয়ালের নম্বর একটি উপজেলার জন্য হওয়ার কথা। কিন্তু লাকীর দেওয়া সিরিয়াল নম্বরের আশপাশের ফরমগুলোতে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার লোকজনকে ভোটার করার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

লাকীর নিবন্ধন ফরম নম্বরের আগের ফরম দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের একজন জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন। আর পরের নম্বরের ফরম দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন কক্সবাজারের একজন।

৪১৮৬৬৬৩৬০ থেকে ৪১৮৬৬৬৩৯৩ নম্বর ফরমের ক্ষেত্রে এরকম চিত্র দেখা গেছে বলে আরিফুল ইসলাম পুলিশকে জানিয়েছেন। যা থেকে পুলিশের ধারণা হয়েছে, লাকীর মত আরও অনেকের হাতে থাকা পরিচয়পত্র হয়ত জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি। 

লাকীর ১৭ ডিজিটের জাতীয় পরিচয়পত্রটি ইস্যুর তারিখ ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর, অথচ কমিশনের সার্ভারে লাকীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ২০১৯ সালে।

কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, লাকীর ঠিকানা যাচাই করতে হাটহাজারি উপজেলার ৩ নম্বর মীর্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। তিনি এ বিষয়ে তথ্য দিতে গত ৮ অগাস্ট সংশ্লিষ্ট সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্যকে চিঠি দেন।

সেই চিঠির উত্তরে ইউপি সদস্য জাহানারা বেগম পুলিশকে জানান, ওই এলাকার বাসিন্দা আব্দুর সালামের মেয়ের নাম ছিল লাকী। মেয়েটি মারা যাওয়ার পর ওই দম্পতি একটি মেয়েকে পালক নেন। মেয়েটি সালাম ও তার স্ত্রী শাহেদা বেগমকে বাবা-মা হিসেবে দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছে এবং বিয়ে করে চট্টগ্রামে বসবাস করছে।

লাকী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। তিনি বলেছেন, তার আসল নাম রমজান বিবি, থাকতেন টেকনাফের হ্নীলা উপজেলার মুচলিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। 

বছর পাঁচেক আগে নজির আহম্মেদ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর চট্টগ্রামে এসে বিয়ে করেন তারা। তাদের যমজ সন্তান হয়। কিন্তু কিছুদিন পর আরেকটি বিয়ে করে সৌদি আরবে চলে যায় নজির।

সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে নজিরের দেওয়া পরমর্শে ‘এক ব্যক্তির সঙ্গে’ যোগাযোগ করে জাতীয় পরিচয়পত্রটি সংগ্রহ করার কথা বলেছেন ২৭ বছর বয়সী ওই নারী।

জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভারে ভুয়া জাতীয় পরিচয় পত্রের তথ্য থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক মন্তব্য করে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে  বলেন, “আমাদের ধারণা, হাটহাজারিতে একটি চক্র রয়েছে যারা রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করছে। তাদের অর্থ সংস্থান করছে সৌদি আরবে থাকা রোহিঙ্গারা।”

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সালে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরিরের চার সদস্যকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে মাধ্যমিক পাস করে ওই যুবক উচ্চ শিক্ষা নিতে না পেরে বাংলাদেশে চলে আসে এবং হাটহাজরিতে আশ্রয় নেয়।    

“যুবকটি সে সময় জানিয়েছিল, বাংলাদেশে আসার পর তাকে একজন হাটহজারিতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। সেখানে গিয়ে একটি চক্রের আশ্রয়ে মেসে ছিল সে।

“আমরা তদন্তে জেনেছিলাম, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লোকজনকে সৌদি আরব থেকে কিছু রোহিঙ্গা বিভিন্নভাবে সাহায্য করে। সৌদি আরব থেকে ওই লোকজন হাটহাজারির কিছু স্থানীয় লোকজনকে টাকা পাঠায়। আর ওই টাকা দিয়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট তৈরির ব্যবস্থা হয়।”

রউফ বলেন, হাটহাজারি এলাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাটহাজারি মাদ্রাসার বেশ কিছু শিক্ষার্থী মেস করে থাকেন। সেখানে স্থানীয় কিছু লোকের আশ্রয়ে রোহিঙ্গারাও থাকে, কিন্তু প্রতিবেশীরা বিষয়টি ধরতে বুঝতে পারেন না।

এই জালিয়াতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপরেনন্স) আব্দুল বাতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাটহাজরির বিষয়টি তদন্ত করে তারা ব্যবস্থা নেবেন।

“কেউ যদি ভুল তথ্য দিয়ে কিংবা এনআইডি সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীকে ব্যবহার করে ডেটাবেইজের তথ্য পরিবর্তন করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তবে এনআইডি ডাটাবেইজকে ‘অরক্ষিত’ বলার সুযোগ নেই মন্তব্য করে বাতেন বলেন, “নির্বাচন কমিশনের তথ্য ভাণ্ডার শতভাগ নিরাপদ ও বিশ্বমানের। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।”

তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

“এরপরও কিছু অসাধু লোকের কারণে কোথাও কোথাও ভোটার হয়ে থাকতে পারে। এ চক্রকে খুঁজে বের করতে হবে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার বাইরে গিয়ে অনেকটা সহজেই ভোটার হওয়ার প্রবণতা থাকতে পারে। সবক্ষেত্রে আমরা দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি।”