‘ইলিশের মওসুমে’ মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা বাতিলে আন্দোলন

সাগরে মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা বাতিলে আন্দোলনের শুরুটা করেছিলেন চট্টগ্রামের জেলেরা, এখন তাতে যুক্ত হয়েছেন মাছ ব্যবসায়ী ও নৌযান মালিকরাও।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2019, 01:56 PM
Updated : 12 June 2019, 02:05 PM

নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের তিন সপ্তাহ পর রোববার মহাসড়ক অবরোধ করে পতেঙ্গা, কাট্টলী এবং সীতাকুণ্ড এলাকার ৩৮টি জেলে পল্লীর জেলেদের সংগঠন উত্তর চট্টলা উপকূলীয় জলদাস সমবায় ফেডারেশন।

এরপর তাদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছে মাছ ব্যবসায়ীদের সংগঠন সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতি এবং নৌযান মালিকদের সংগঠন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণকারী বোট মালিক সমিতি।

তারা বলছেন, ইলিশ ধরার মৌসুমে সাগরে মাছ ধরতে না পারায় তাদের জীবিকা সঙ্কটে পড়েছে।

গত চার বছর ধরেই ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে; উদ্দেশ্য প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে মাছের মজুদ সংরক্ষণ করা।

আন্দোলনরত জেলে-মৎস্য ব্যবসায়ী ও নৌযান মালিকদের দাবি, মূলত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাগরে ও উপকূলে ইলিশ আহরণের মওসুম।

উত্তর চট্টলা উপকূলীয় জলদাস সমবায় কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি উপেন্দ্র জলদাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা গভীর সাগরে যেতে পারি না। উপকূলেই মাছ ধরি।

“ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন (১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর) মাছ ধরা বন্ধ থাকে, সেটা ঠিকই আছে। মে মাস থেকে পাঁচ মাস ইলিশ ধরার সময়। এই আয় দিয়েই আমরা পুরো বছর চলি। এর মধ্যে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকলে আমরা ইলিশ ধরব কখন?”

“প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধের সময় আরও বাড়ালে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এই ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চাই,” বলেন এই মৎস্যজীবী।

এর আগে এই সময়ে বাণিজ্যিক ট্রলারের জন্য নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও চলতি বছর সব ধরনের নৌযানের জন্য তা শুরু হয়েছে।

তাতেই বিপাকে পড়ে যান্ত্রিক (মেকানাইজড) ও অযান্ত্রিক (নন মেকানাইজড) নৌযানের মাঝি-মাল্লারাও নেমেছেন আন্দোলনে।

বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলে যান্ত্রিক নৌযানের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। প্রতিটি নৌকায় কাজ করেন ২১ থেকে ৫০ জন পর্যন্ত মাঝি-মাল্লা।

পতেঙ্গা, কাট্টলী ও সীতাকুণ্ডের ৩৮ জেলে পল্লীতে এই পেশার উপর নির্ভরশীল ৫৩ হাজার পরিবার আছে বলে দাবি জলদাস সমবায় ফেডারেশনের। উপকূলীয় এলাকায় জেলে নৌকা (অযান্ত্রিক) ব্যবহার করেই মাছ ধরে তারা।

ফিশারিঘাট এলাকায় যান্ত্রিক নৌযানের মাঝি হেলাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই রমজান কীভাবে কেটেছে আমরাই জানি। ঈদে পরিবারের কাউকে কিছু দিতে পারিনি।

“সংসারে ১০ জন মানুষ। আয় করি দুই জন। সংসার কীভাবে চলে? আমরা ভাসান জালে বড় মাছ ধরি। এ জালের ফাঁস চার ইঞ্চি। এটাতে ছোট মাছ ধরা পড়ে না। এখন ইলিশ না ধরলে সারা বছরের খোরাকি যোগাড় হবে না।”

সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বাবুল সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই চার-পাঁচ মাস মূলত ইলিশ ধরার সময়। এখন মাছ ধরতে না পারলে যান্ত্রিক নৌযানের মাঝি-মাল্লারা অভুক্ত থাকবে। তারা দিন আনে দিন খায়।

“প্রশাসনের সাথে দুই দফা বৈঠকে বারবার এটা বলেছি। কেউ শোনেনি। আমলারা ভুল বুঝিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে।”

একই কথা বলেন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণকারী বোট মালিক সমিতির সভাপতি নুর হোসেনও।

এখন সামুদ্রিক মাছের প্রজনন মৌসুম হলেও ইলিশের প্রজনন মৌসুম নয় বলেন তিনি।

“বছরের অন্য সময় যে ইলিশ ধরা পড়ে, তার স্বাদ ও চাহিদা কম। এই সময়ের ইলিশের চাহিদা বেশি, ধরাও পড়ে বেশি। কিন্তু এখন আমরা বোট নিয়ে বসে আছি।”

তবে বাণিজ্যিক ট্রলারের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা ঠিক আছে বলের মনে করেন নুর হোসেন।

“আমারও বাণিজ্যিক ট্রলার আছে। ওইসব ট্রলারে যেভাবে ট্রলিং করা হয়, তাতে ধরা পড়া মাছের চেয়ে নষ্ট হওয়া মাছের পরিমাণ বেশি।”

নুর হোসেন জানান, এ সময় ইলিশ মাছই ধরা হয় যান্ত্রিক নৌযান দিয়ে।

অন্যদিকে যান্ত্রিক নৌযান সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম উপকূলে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞায় কড়াকড়ি থাকলেও বরগুনা, বরিশাল, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকা সংলগ্ন উপকূল ও সাগরে কড়াকড়ি নেই। সেখানে মাছ ধরাও চলছে।

দেশে সরকার অনুমোদিত ২৫৫টি বাণিজ্যিক ট্রলার আছে। যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক নৌযানের সংখ্যা প্রায় ৬৮ হাজার। 

এরমধ্যে তটরেখা থেকে সাগরের ৩২ হাজার ৪৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক নৌযান। পরের দুই স্তরে গভীর সাগরে মাছ ধরে বাণিজ্যিক ট্রলার।

সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক আবুল হাসানাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”চার বছর ধরে সচেতন করার পর এবার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়েছে।

“২০১৫ সাল থেকে বাণিজ্যিক ট্রলারের জন্য নিষেধাজ্ঞা আছে। তারা আহরণ করে মাত্র ১৩ শতাংশ মাছ আর যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক নৌযান আহরণ করে ৮৭ শতাংশ।”

নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে সামুদ্রিক মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন হলে তার সুফল পরবর্তীতে মৎস্যজীবীরাই পাবেন বলে আশা করছেন তিনি। 

এদিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিয়েছে জলদাস সমবায় ফেডারেশন। স্থানীয় তিন সাংসদের সুপারিশসহ চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন তারা।

এ নিয়ে জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “তাদের দাবি সম্বলিত চিঠি পেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।”

মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল হাসানাত বলেন,  “প্রধানমন্ত্রী কোনো দিক নির্দেশনা দিলে তা আমরা বাস্তবায়ন করব।”