পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসতি উচ্ছেদে অগ্রগতি কম

বর্ষায় পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে চট্টগ্রামের ১৭ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় এক মাসের মধ্যে অবৈধ বসতিমুক্ত করার প্রশাসনিক নির্দেশ ৪৫ দিনেও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

মিন্টু চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2019, 03:54 PM
Updated : 10 June 2019, 03:57 PM

সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন চট্টগ্রাম মহানগরীর এসব পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে।

দ্রুত অভিযান শুরু করা না গেলে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে প্রাণহানির মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই যায়।

প্রশাসনের নির্দেশের পর ৪৫ দিনে নগরীর লালখান বাজার মতিঝর্ণা, পোড়া কলোনি, উত্তর পাহাড়তলীর লেকভিউ আবাসিক এলাকা এবং আমবাগান এলাকার এ কে খানের পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে সাড়ে তিনশ’র মতো পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

অভিযানে ওইসব এলাকার ৪১টি বিদ্যুতের অবৈধ মিটার ও একটি ট্রান্সফরমার বিচ্ছিন্ন করা হয়। একটি অবৈধ ট্রান্সফরমার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বিচ্ছিন্ন না করে ফিরে আসতে হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতকে। 

এছাড়া ওইসব এলাকা থেকে অবৈধভাবে নেয়া গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। বর্ষা মৌসুম আসন্ন হলেও রোজার কারণে মানবিক দিক বিবেচনায় উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম পিছিয়ে গেছে বলে প্রশাসনের দাবি।

দ্রুতই বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস করা ৪৮৫ পরিবারকে উচ্ছেদে অভিযান শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রেভেনিউ) দেলোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভিযান শুরুর পর স্থানীয়ভাবে কিছু বাধা আসলেও আমাদের কার্যক্রম কিন্তু চালু ছিল। রোজার কারণে অভিযান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ছিল। দ্রুতই আমরা ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বাকি বসতি উচ্ছেদের কাজ শুরু করব।”

গত ১৬ এপ্রিল কমিটির সভায় পরবর্তী একমাসের মধ্যে প্রশাসনের করা তালিকা অনুযায়ী ১৭ পাহাড়ের ৮৩৫ পরিবারকে উচ্ছেদ করে পাহাড় খালি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিভাগীয় কমিশনার।

ওই সভাতেই পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে পাহাড়গুলোর ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে থাকা অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থার দেওয়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।

উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিককে প্রধান করে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটিও করা হয়।

সে অনুযায়ী গত ২ মে নগরীর লেকভিউ আবাসিকের ঝিলপাড় এলাকা থেকে অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেখানে আটটি বিদ্যুতের মিটার ও একটি ট্রান্সফরমার বিচ্ছিন্ন করা হয়। অভিযানের পরদিন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা ট্রান্সফরমার খুলে আনতে গেলে তাদের ওপর প্রভাবশালীরা হামলা চালায়।

গত ৪ মে মতিঝর্ণা এলাকায় অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয় প্রায় দুইশর মতো পরিবারকে, বিচ্ছিন্ন করা হয় ২৪টি বৈদ্যুতিক মিটার। সেখানে অবৈধভাবে থাকা একটি ট্রান্সফরমার বিচ্ছিন্ন করতে গেলে লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহিলাদলনেত্রী মনোয়ারা বেগম মনির বাধার কারণে তা করা যায়নি।

গত ৫ মে লালখান বাজার পোড়া কলোনি এলাকার পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ৭০ পরিবার উচ্ছেদ এবং সাতটি মিটার জব্দ করা হয়। ৯ মে আমবাগান এলাকার একে খান পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ৭০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়, বৈদ্যুতিক মিটার বিচ্ছিন্ন করা হয় সাতটির মতো।

এরপর এখন পর্যন্ত প্রশাসনের উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের বাকি পরিবার উচ্ছেদে কোন অভিযান চালানো হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিলাম। তিনশর বেশি পরিবার উচ্ছেদ এবং বিদ্যুৎ-পানিসহ অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

“৯ মে’র পর রোজার কারণে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষা শুরুর আগে কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা সভা করে পুনরায় উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করব।”

প্রতিবারই বর্ষা মৌসুম শুরুর পূর্বে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা করে সেখানে বসতি স্থাপনকারী পরিবার চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয় না, ঠেকানো যায় না পাহাড় ও ভূমিধসে প্রাণহানি।

চট্টগ্রামের পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী শরিফ চৌহান বলেন, “প্রতিবছরই উচ্ছেদ করার কথা বললেও বাস্তবে এর কোন ফল মিলে না। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় পাহাড় কেটে এর খাঁজে ঘর তুলে কম ভাড়ায় লোকজন নিয়মিতই বসতি গড়ে যাচ্ছে।”

এ থেকে উত্তরণে প্রশাসনের জোরদার ভূমিকার সাথে পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করার বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ জানান। 

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন বলেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে স্বল্প আয়ের লোকজন কম ভাড়ায় অবৈধভাবে ঝুঁকি নিয়ে থাকে। শুধু প্রশাসনের একার পক্ষে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

“যদি পাহাড়ের মূল মালিকরা যথাযথভাবে উচ্ছেদ করতে আগ্রহী না হন বা ব্যবস্থা না নিলে পাহাড়গুলো থেকে পুরোপুরিভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করা যাবে না বলে মনে করি। এজন্য পাহাড় মালিকদের প্রকৃত অর্থেই এগিয়ে আসতে হবে।”

সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়গুলোতে অভিযান পরিচালনাকারী চট্টগ্রামের কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “এবারে অভিযানে আমরা শুধু পরিবার উচ্ছেদ করছি না, সেখানে দেওয়া পানি-বিদ্যুতের সকল অবৈধ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করছি।

“অনেক সময় বাধা আসছে, কিন্তু আমাদের অভিযান থামেনি। বাকি ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরাতে আমরা দ্রুতই অভিযানে যাব।”

প্রশাসনের করা তালিকার ১৭ টি পাহাড়ের মধ্যে ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন ও বাকি সাতটি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত এবং জাতয়ি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের রয়েছে।

২০০৭ সালের ১১জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ও দেয়াল ধসে এবং মাটি চাপায় মৃত্যু হয়েছিল ১২৭জন। ওই বছর থেকে পরবর্তী ১২ বছরে চট্টগ্রাম পাহাড় ও দেয়ালধস, মাটি চাপা এবং পানির তোড়ে মারা গেছে মোট ২১৮ জন।

২০১৭ সালের ১২-১৩ জুন রাঙামাটিসহ মিলিয়ে এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩৫১জন। এর মধ্যে শুধু রাঙামাটিতেই নিহত হয় ১১০জন।

পাহাড় ধসে মৃত্যু

# ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের সাতটি স্থানে মাটিচাপায় ১২৭ জনের মৃত্যু হয়

# ২০০৮ সালের ১৮ অগাস্ট চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়

# ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়

# ২০১২ সালে ২৬-২৭ জুন চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে

# ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে ২ জন মারা যায়

# ২০১৫ আমিন কলোনি ও লালখান বাজারে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ৬ জনের মৃত্যু ঘটে

# ২০১৭ সালে দুটি ঘটনায় মোট ৭ জন মারা যায়

# ২০১৭ সালের ১২-১৩ জুন রাঙামাটিতে ১১০ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জন, বান্দরবানে ৬, খাগড়াছড়িতে ২ জন এবং কক্সবাজারে ১ জনসহ মোট ১৫৬ জন মারা যায়