সরকারি খাস জমিতে ‘অবৈধ’ ভেড়া কলোনি বস্তি

বন্দর নগরীর চাক্তাইয়ে সরকারি খাস জমিতে গড়ে ওঠা ভেড়া কলোনি বস্তিটি অবৈধ বলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেটিতে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় তিন পরিবারের আটজন।

মিন্টু চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2019, 06:45 PM
Updated : 17 Feb 2019, 06:48 PM

প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্ণফুলী নদী অদূরে রাজাখালী খালে তীরে সরকারি খাস জমিতে ২০ বছর আগে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ঘর, পরে রূপ নেয় বিশাল বস্তিতে।

বাকলিয়া থানাধীন চাক্তাই ভেড়া মার্কেট লাগোয়া খাল পাড়ের এসব খাস জমির দখলদারের সংখ্যা অন্তত পাঁচজন বলে জানা গেছে। ৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়ায় নিম্ন আয়ের লোকদের কাছে এক ও দুইকক্ষ বিশিষ্ট এসব ঘর ভাড়া দেওয়া হত।

এসব ঘরে ভাড়া তোলার জন্য বেশ কয়েকজন লোক নিয়োজিত আছেন, যাদের কেরানি বা মাঝি হিসেবে ডাকেন ভাড়াটিয়ারা।

রোববার ভোররাতে অগ্নিকাণ্ডের পর বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব কুমার চৌধুরী বলেছিলেন, সরকারি খাস জমিতে এ বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে।

তবে কারা এ বস্তি অবৈধভাবে গড়ে তুলেছে তার কোন ধারণা তিনি দিতে পারেন নি।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে খাস জমি দখল করে গড়ে ওঠা বস্তিটি উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না।

ওই বস্তি বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পশ্চিম পটিয়ার শিকলবাহা এলাকার ফরিদ সওদাগর, সাত্তার আহমেদ, পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের আবু তৈয়ব চৌধুরী, ফরিদ চেয়ারম্যান, নুরুল আমিন হাজী ও জীবন ওই বস্তির বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

প্রতিজনের দখলে থাকা বস্তির ঘরগুলোকে তাদের নামের ‘কলোনি’ হিসেবেই চেনে সবাই।

তাদের সহযোগিতাকারী হিসেবে ৩৫ নম্বর বক্সির হাট ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি মো. আক্তার ওরফে কসাই আক্তার ও করিম নামে দুই ব্যক্তি আছেন বলে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন। 

বস্তির যে অংশে আগুন লেগেছে সেখানে ফরিদ সওদাগরের নিয়ন্ত্রণাধীন ৫০টির মতো ঘর পুড়ে গেছে। ফরিদের চাক্তাই এলাকায় একটি চায়ের দোকান রয়েছে।

নিজেকে বস্তির ওইসব ঘর ও জমির খরিদ সূত্রে মালিক দাবি করে ফরিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আরএস মূলে এসব জায়গা আমি ২০ বছর আগে কিনেছি। আমার মতো আরও কয়েকজন চর পাড়ের এসব খাস জমি কিনেছে।”

সরকারি খাস জমিতে অবৈধভাবে ঘর তুলেছেন কি না- জানতে চাইলে ফরিদ সওদাগর বলেন, “হাই কোর্ট থেকে আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। আমরা এসব জায়গার মালিক।”

ফরিদ সওদাগর দাবি করেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তিনি যুক্ত নন।

ফরিদ চেয়ারম্যান ও জীবনের মালিকানাধীন ঘরের দেখভাল করেন পটিয়া কুসুমপুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা সগির মেম্বার, তিনি ভেড়া কলোনির বস্তির লোকদের কাছে ‘সগির কেরানি’ হিসেবে পরিচিত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সগির বলেন, এখানে মোট ৫২ গণ্ডা জমি আছে। সেখানে যে যার মালিকানাধীন ঘর থেকে ভাড়া তোলেন।

সগির যাদের টাকা তোলেন, দুজনই বিদেশে থাকেন।

তাদের জায়গা খাস জমি নয় দাবি করে তিনি বলেন, প্রকৃত অর্থেই তারা জায়গার মালিক।

ফরিদ সওদাগর ও সাত্তার আওয়ামী লীগ করেন বলে সগির দাবি করেন।

কসাই আক্তার ও করিমের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ে মেরিন ড্রাইভ সড়ক। সড়কের উত্তর পাশে লাগোয়া রাজাখালী খাল। সেই খালে পাড় ধরে ভেড়া কলোনি বস্তি। চাক্তাই ভেড়া মার্কেটের পেছনে এটি গড়ে ওঠায় এর নাম ভেড়া কলোনি বস্তি হয়েছে।  

রোববার ভোরের আগুনে এক বা দুই কক্ষ বিশিষ্ট প্রায় দুইশটি ঘর পুড়ে গেছে। ওই বস্তিতে পাঁচশর মতো কাঁচা ঘর ও দোকান রয়েছে।  

কর্ণফুলী নদী কাছে হওয়ায় খালের পাড়ে চরের জায়গায় ২০ বছর আগে থেকে ধীরে ধীরে অবৈধ দখলদাররা দখলে নিয়ে বস্তিঘর গড়ে তোলে। সেখানে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও গ্যাস ও পানির সংযোগ নেই।

চাক্তাই ভেড়া কলোনির জায়গা সরকারি খাস জমি বলে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম সদর সার্কেলের দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাবরিনা আফরিন মোস্তফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকারি খাস জমিতেই তারা ঘর করে থাকছেন।

জমির পরিমাণ কতুটুক তার সঠিক কোন ধারণা তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে না পারলেও বলেন, “ইতোপূর্বে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তা বর্তমানে করতে পারছি না।”

আইনগত দিকটির সুরাহা হলে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে বলে জানান সাবরিনা আফরিন।

অগ্নিকাণ্ডের পর ওই এলাকার লিল মিয়া, হোসনে আরা বেগম, মো. আকবরসহ বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, ১০-১৫ দিন আগে এ বস্তি উচ্ছেদ করা হবে বলে শুনেছিলাম। কিন্তু পরে ঘরের মালিকের লোকজন এসে জানায়, উচ্ছেদ হবে না।

সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ের উচ্ছেদ কার্যক্রম শেষ করেছে প্রশাসন।

পতেঙ্গা ও চাক্তাই এলাকায় পরবর্তীতে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে।