সোহেল চাঁদাবাজ ছিলেন না, দাবি পরিবারের

মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মহিউদ্দিন সোহেলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তার পরিবারের দাবি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2019, 02:43 PM
Updated : 8 Jan 2019, 02:50 PM

চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে সোহেল নিহত হওয়ার পরদিন মঙ্গলবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে তার ‘পরিবার, স্বজন ও সহযোদ্ধাদের পক্ষে’ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সোহেলের ভাই শাকিরুল ইসলাম শিশির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ, আমার ভাইয়ের নামের পাশে যে ‘চাঁদাবাজ’ লিখেছেন, সেটা যেন মুছে দেন। আমরা আর কিছু চাই না।”

সোমবার সকালে পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজারে গণপিটুনিতে নিহত হন মহিউদ্দিন সোহেল (৪২)। অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা আবদুল বারেকের ছেলে সোহেল রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার বলে পরিবার জানিয়েছে।

সোহেল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক। এর আগে তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে সোহেল পরিচিত ছিলেন।

সোহেলের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির বিভাগীয় সমন্বয়ক শওকত বাঙ্গালী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন, গাফফারি রাসেল, ফাহিম খান রনি ও মোখতারুল, বন্ধু সাজ্জাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

সোহেলের বাবা আবদুল বারেক, মা ফিরোজা বেগম, দুই বোন রাজিয়া সুলতানা ও নাজনীন সুলতানার পাশাপাশি দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন স্ত্রী নিগার সুলতানা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শিশির বলেন, মূলত পাহাড়তলী বাজার ও আশেপাশের এলাকাকে সিসি ক্যামরার আওতায় আনার উদ্যোগ, মাদক-সন্ত্রাসমুক্ত এলাকা করার ঘোষণা ও কাজ শুরু এবং পাম্প হাউজ কলোনির রাস্তা আলোকিত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়াই তার ভাইয়ের জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ায়।

“আমার ভাই ছাত্র রাজনীতি এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতি করার পাশাপাশি একজন ঠিকাদার। কোনো চাঁদাবাজ নন। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকায় ছিলেন। রাজনৈতিক অভিভাবক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের পরামর্শে পাহাড়তলীকে মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করার কাজ শুরু করেন।”

শিশির দাবি করেন, কয়েকটি মাদক আখড়া ভেঙে দেওয়ার পর স্থানীয় কাউন্সিলর সাবের আহম্মেদ ও জাতীয় পার্টির নেতা ওসমান খান তার ভাইয়ের উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন।

“আমার ভাইয়ের নামে থানায় কোনো মামলা নেই। পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। পাশাপাশি তাকে চাঁদাবাজ তকমা দিয়ে তার সারাজীবনের রাজনৈতিক চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে।

“গণপিটুনিতেই যদি আমার ভাই মারা যাবে, তাহলে তার শরীরে ২৬টি ছুরির আঘাত কেন?”

সোহেল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দাবি করেন শিশির।

‘চাঁদাবাজির’ অভিযোগ ও ঘটনাক্রম

পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজারের ব্যবসায়ীরা সোমবার অভিযোগ করেন, মহিউদ্দিন সোহেল ওই বাজারে পণ্য নিয়ে আসা প্রতি ট্রাক থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা নিতেন। সোমবার থেকে সেই চাঁদা ১০০ টাকা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সোহেল।

সোমবার ডবলমুরিং থানার ওসি এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিমও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বাজারের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে একই অভিযোগ ওঠার কথা বলেছিলেন।

চাঁদা বাড়ানোর প্রতিবাদে সোমবার সকালে বাজারে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয় বলেও কয়েকজন ব্যবসায়ী সোমবার সংবাদকর্মীদের বলেছিলেন।

তবে মঙ্গলবার ঘটনা সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া গেছে।

শিশির বলেন, “সকালে বাচ্চাদের জন্য ফল কিনতে আমার ভাই (সোহেল) বাজারে যান। বাজারে রেলের যে ঘর দখলে রাখার কথা বলা হচ্ছে, আসলে সেই জমি আমার ভাই লিজ নিয়েছিলেন গুদাম করার জন্য।”

সংবাদ সম্মেলনে সোহেলের এক বন্ধু বলেন, বাজারের ব্যবসায়ী ওসমান খানের সঙ্গে সোহেলের কথা কাটাকাটি হয়। ওসমান খান শুরুতে সোহেলকে আঘাত করেছিলেন। এরপর সোহেলের সঙ্গীরা ওসমান খানের মাথায় আঘাত করেন।

বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, চাঁদা চেয়ে না পেয়ে ওসমান খানের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল সোহেলের সঙ্গীরা।

চিকিৎসাধীন ওসমান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোহেলের ঘরের ওখানে একটা গেইট আছে। সেটা দিয়ে বাজারের লোকজন যাতায়াত করে। সেই গেইট গতকাল সকালে বন্ধ রাখা হয়। তা নিয়ে আমার সাথে কথা কাটাকাটি হয়।

“এরপর সোহেলের লোকজন আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়। তারপর কীভাবে কী হয়েছে আমি জানি না।”

ওসমান জাতীয় পার্টির নগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সদস্য।

চাঁদা দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অন্যদের কাছে চাঁদা চেয়েছিল আগে। আমার কাছে চাঁদা চায়নি। বাজার থেকে চাঁদা নিত বলে শুনেছি।”

ওসমান খানের মাথা ফাটার পর বাজারের মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে ব্যবসায়ী-দোকান কর্মচারীদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয় বলে অভিযোগ নিহত সোহেলের বন্ধুদের।

মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ব্যবসায়ীদের ডাকা হয় বলে বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির আহ্বায়ক ও ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাবের আহম্মেদ স্বীকার করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহিউদ্দিন সোহেল বাজারে চাঁদাবাজি করত। কিন্তু ভয়ে কেউ থানায় অভিযোগ দিত না। তাই থানায় জিডি বা মামলা হয়নি।”

সাবের জানান, বাজারে লাইনম্যানদের বেতন দেওয়ার জন্য সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়।

ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, সোহেল এর বাইরে ট্রাক থেকে চাঁদা নিতেন।

সাবেক বলেন, “ট্রাক থেকে সোহেলের চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি আমি জানতাম না। তাই পুলিশকে জানাতে পারিনি। সে বাইরের লোক, রেলের জমি দখল করে বাজারে বসে থাকত।”

পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজার এলাকায় মাদক ব্যবসার বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর সাবের বলেন, “মাদক ব্যবসা সোহেল নিজেই করত। এর আগে বাজারে ওসমান খানের একটা জুয়ার আসর ছিল। সেগুলো আমি নিজেই বন্ধ করে দিই। পরে সোহেল আবার এসব কাজ শুরু করে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসমান খান বলেন, “এত বিষয়ে বলতে পারব না। আমরা ডায়াবেটিস বেড়ে গেছে, মাথায় সেলাই পড়েছে। আপনারা স্পটে যান। বাজারের লোকজনের সাথে কথা বলেন।”

শিশির দাবি করেন, তার ভাইকে মারার সময় পুলিশকে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি।

সোমবার নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (ডবলমুরিং) আশিকুর রহমানও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, বাজারের লোকজনের বাধা ডিঙিয়ে পুলিশ সোহেল ও তার সহযোগী রাসেলকে উদ্ধার করে।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছিল, তারা পৌঁছার আগেই সোহেলের ঘরে দেওয়া আগুন স্থানীয়রা নিভিয়ে ফেলে এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও বাজারে ঢুকতে পারেননি।

সোহেলের মৃত্যুর ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি।

পুলিশ কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোহেলের পরিবারের সাথে আমরা যোগাযোগ করেছি। তারা এখনও মামলা করতে আসেননি। আসলে অবশ্যই মামলা নেওয়া হবে।”

সুরতহাল প্রতিবেদন এখনও না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সোহেলের শরীরে আঘাতের ধরন কেমন বা কয়টি, তা এখনই বলতে পারছেন না তিনি।