একাত্তরের আগে-পরের বাংলাদেশ নিয়ে উপন্যাস লিখতে চান সমরেশ

আরো একটি উপন্যাস লেখার অভিপ্রায় জানালেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার; আর তার এই উপন্যাসের পটভূমি হবে বাংলাদেশ ঘিরে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2018, 07:38 PM
Updated : 7 Dec 2018, 07:38 PM

শুক্রবার চট্টগ্রামের বইবিপণি বাতিঘর আয়োজিত ‘সমরেশ মজুমদার: আলাপচারিতা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে পাঠকপ্রিয় উপন্যাস সাতকাহন, গর্ভধারিণী, অগ্নিরথের লেখক সমরেশ মজুমদার বলেন, ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে ১৯৭১ এবং এরপর বাংলাদেশে যে পরিবর্তন এলো তা নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে চান তিনি।  

চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনের বঙ্গবন্ধু হলে সমরেশের সঙ্গে আলাপচারিতা সঞ্চালনা করেন কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী।

আলাপচারিতায় শৈশবের স্মৃতি, গল্প লেখার নেপথ্য কাহিনী, উপন্যাস লেখা শুরু, জীবন ফিরে পাওয়ার কথা জানান ৭৬ বছর বয়সী সমরেশ।

জবাব দিয়েছেন পাঠকের নানা প্রশ্নের। জানালেন কবি হতে না পারা নিয়ে নিজের আক্ষেপের কথাও।

সঞ্চালক কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী লেখকের কাছে জানতে চান, ডুয়ার্সের চা বাগানে কাটানো শৈশব সমরেশের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে?

জবাবে তিনি বলেন, “প্রায় ৫০ বছর ধরে আমি কলকাতায় আছি। তবু বছরে দুবার চা বাগানে না গেলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। শৈশবে যাদের সাথে খেলতাম তারা অনেকেই আর নেই। তবু যাই। যারা আছে তাদের সাথে আড্ডা দেই।”

সাত বছর বয়সে দেখা চা বাগানের আদিবাসী কিশোরীর সঙ্গে ৬৫ বছর পর আবার নাটকীয়ভাবে দেখা হওয়া এবং শৈশবের বন্ধু রেথিয়ার জীবনাবসানের বিষাদময় স্মৃতিচারণ করেন সমরেশ মজুমদার।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে ৫১ বছরের সাহিত্যচর্চা নিয়ে সমরেশ বলেন, “আজ থেকে আড়াই বছর আগে ঈশ্বর আমাকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেছিলেন। এক রাত্রি বেলায়, আমার স্ট্রোক হয়েছিল। সাত দিন পরে আমি জ্ঞান ফিরে পাই।

“এই যে আমরা কত কথা বলি, কত লিখি, কত স্বপ্ন দেখি- আমাদের সব কিছু হারিয়ে যায়। হসপিটাল থেকে যখন বাড়ি এলাম, আমি বাংলা অক্ষর চিনতে পারিনি। ছোট মেয়ে স্লেটে অ-আ-ক-খ শিখিয়েছিল। এরপর তিন মাসের মধ্যে আনন্দবাজারের জন্য আমার উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। কিন্তু পরের লাইন লিখতে গিয়ে আগের লাইন কী লিখেছি, তা ঝাপসা দেখতে পেতাম।”

পাঠকদের উদ্দেশ্যে দুই বাংলার বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলেন, “সেখান থেকে আপনাদের ভালোবাসায়-আশির্বাদে খুব দ্রুত আমার ফিরে আসা। আবার লিখছি আপনাদের ভালোবাসায়।”

লেখালেখি শুরুর গল্প বলতে গিয়ে সমরেশ বলেন, “কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবারো ভাবিনি লেখক হব। গ্রুপ থিয়েটার করতাম। গ্রুপ থিয়েটারের জন্য নাটক লিখলাম, হয়নি। আবার লিখলাম, হয়নি।

“এক বন্ধু বললো গল্প লেখ, তারপর নাট্যরূপ দে। অনেক কাণ্ডের পর সে গল্প দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।”

দেশ সম্পাদক সাগরময় ঘোষের প্রেরণায় রেসকোর্সের ঘোড়দৌড় নিয়ে লেখা ‘দৌড়’ দিয়ে উপন্যাসে হাতেখড়ি হয় সমরেশ মজুমদারের।

“তখন লোকে যদি বলত, কেন লেখেন? আমি বলতাম, টাকার জন্য লিখি। এই কথাটা আমরা ঘৃণার চোখে দেখতাম। কিন্তু আমি বলতাম।”

চার বছর আগে চট্টগ্রামে এসে পাঠকের মুখোমুখি অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, প্রথম গল্প লিখে ১৫ টাকা পেয়েছিলেন তিনি।

ত্রয়ী উপন্যাস উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষের লেখক সমরেশ বলেন, “উনি (সাগরময় ঘোষ) বললেন, যদি কোনো বিষয় না পাও, নিজেকে নিয়ে লেখ। ভাবতে ভাবতে নিজের ছায়াকে নিয়ে শুরু করলাম- উত্তরাধিকার। উত্তরাধিকার শেষ হতে চায় না। অনিমেষ কলকাতা এলো, তার গায়ে গুলি লাগল। এভাবে শেষ করলাম, আমি ভাবলাম বাঁচা গেল।”

এরপর কীভাবে ‘কালবেলা’ লেখা শুরু তা নিয়েও বলেন এই উপন্যাসিক।

“দিন দশেক পরে সাগরময় ঘোষ আমায় ডাকালেন। উনার সামনে ট্রে ভর্তি চিঠি। বললেন, একটা চিঠি তোলো, পড়।

“আমি একটা চিঠি তুলে পড়লাম। তাতে লেখা- আপনারা বুর্জোয়া কাগজ, তাই গরিবদের পক্ষের লেখক সমরেশ মজুমদারকে আপনারা লিখতে দেননি। আমরা দেশ পত্রিকা বর্জন করব।

“সাগরময় দা বললেন, প্রত্যেক চিঠিতে এই কথা লেখা আছে। আমি কি তোমাকে বলেছি বন্ধ কর? শেষ করলে কেন? আমাকে গালাগাল খেতে হয় কেন? বললাম- আমি পারিনি।

“তিনি বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে ১০ দিন সময় দিলাম। ১৭ দিন পর তোমার দ্বিতীয় উপন্যাস ছাপা হবে। লিখলাম- কালবেলা। এর নায়ক-নায়িকারা পুরোপুরি বাস্তবে ছিল না। ছায়া ছিল। আমি তাদের রক্তে মাংসে গড়েছি।”

জনপ্রিয় আর উঁচু মানের সাহিত্যের মধ্যে ফারাক আর এ নিয়ে নানা বিতর্ক থাকার প্রসঙ্গে তুলে বিষয়টিতে সমরেশ মজুমদারের অভিমত জানতে চান সঞ্চালক।

জবাবে তিনি বলেন, “আমি একশ ভাগ একমত। চিলেকোঠার সেপাই অত্যন্ত উঁচু মানের সাহিত্য, অতি জনপ্রিয় কি?”

বাতিঘরের আয়োজনে সমরেশ মজুমদার প্রথমবার চট্টগ্রাম আসেন ২০১৪ সালে। এরপর প্রতিবারই চট্টগ্রামের ভক্তদের ভালোবাসায় আবেগাপ্লুত হন এই লেখক।

পুরনো খবর