জননী সাহসিকা রমা চৌধুরীর শেষ বিদায়

লাল-সবুজের পতাকা ঢাকা দেহ শহীদ মিনারের সামনে অস্থায়ী মঞ্চে রাখা; চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে নানা বয়সী শ্রেণি-পেশার মানুষ। লাইন ধরে একে একে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিরবে হেঁটে যাচ্ছে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2018, 09:54 AM
Updated : 3 Sept 2018, 12:17 PM

বিনম্র শ্রদ্ধায় মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা জননী সাহসিকা রমা চৌধুরীকে এভাবেই শেষ বিদায় জানালো তার জন্মভূমি চট্টগ্রামের মানুষ।  

সোমবার বেলা ১১টার দিকে রমা চৌধুরীর মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হয়। ততক্ষণে সেখানে সমবেত হয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সংবাদ কর্মী ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা।

সেখানে রমা চৌধুরীকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শহীদ জায়া মুশতারী শফি বলেন, “উনার পুরো জীবন জুড়েই শুধু আত্মত্যাগ আর সংগ্রাম। জননী সাহসিকা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

“তিনি অনেক বই রচনা করেছেন; অনেক লিখেছেন। সেসব লেখা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়নি। আমাদের উচিত তার স্মৃতিকে ধরে রাখা।”

মায়ের মরদেহের কাছে দাঁড়িয়ে কান্নারত সন্তান জহর লাল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার মা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন। তাই একাত্তরে তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

“আমার মা চাপা অভিমান নিয়ে চলে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি অনেকের দ্বারে গিয়েছিলেন। কেউ তখন তাকে সহায়তা করেনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন আমার মায়ের স্মৃতি সংরক্ষণ করা হোক।”

বোয়ালখালীতে শ্বশুরালয়ে একটি এতিমখানা ও একটি বৃদ্ধাশ্রম করার স্বপ্ন ছিল রমা চৌধুরীর। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ আহ্বান করেন জহর লাল চৌধুরী।

সংস্কৃতিকর্মী আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, জীবনজুড়েই তিনি আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কখনো কারো কাছে মাথা নত করেননি। মাথা উঁচু করেই তিনি চলে গেলেন।

শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে অধ্যক্ষ রীতা দত্ত নত মস্তকে প্রণাম জানান এই বীরাঙ্গনাকে।

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরীকে হারিয়ে আজ পুরো দেশ শোকাহত। চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে উনাকে শ্রদ্ধা জানাতে পেরে আমি গর্বিত।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন বলেন, উনি জীবদ্দশায় কারো কাছ থেকে কিছু নেননি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সময়ও তিনি কিছুই চাননি।

“সারাজীবন মাথা উঁচু করে তিনি জীবনযাপন করেছেন। এক সংগ্রামী জননী আজ চির বিদায় নিলেন।”

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে ফুল দিয়ে দলীয় নেতারা শ্রদ্ধা জানান।

এরপর রমা চৌধুরীকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন ও সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা।

একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীরা। ছবি: সুমন বাবু

শ্রদ্ধা জানান ওয়ার্কার্স পার্টি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান, নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু, প্যানেল মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী, হাসান মুরাদ বিপ্লব ও নীলু নাগ এবং নগর ছাত্রলীগ সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু।

এছাড়া চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত আবৃত্তি জোট, বোধন, প্রমা, খেলাঘর, গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রাম, উদীচী, ছাত্র ইউনিয়ন, বাসদ এবং নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল, অর্পনাচরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মুসলিম হাইস্কুল, পাহাড়িকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থী তাকে সম্মান জানান।

জেলা প্রশাসনের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান এবং নগর পুলিশের পক্ষে অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোস্তাইন হোসেন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

শেষে পুলিশের একটি দল রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অব অনার জানাতে শহীদ মিনারের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর।

উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. শাহাবুদ্দিন ও মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দাঁড়িয়ে তখন এই বীরাঙ্গনা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

পুলিশ সদস্যরা সশস্ত্র সালাম জানিয়ে গার্ড অব অনার শেষ করেন।

এরপর রমা চৌধুরীকে নেওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের আবাসস্থল চেরাগী পাহাড়ের লুসাই ভবন চত্বরে। কালো কাপড়ে ঢাকা মঞ্চে রাখা হয় তার মরদেহ।

সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে এসে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, উনি চট্টগ্রামের গর্ব। উনাকে হারিয়ে আমরা শোকাহত। মেয়র মহোদয় হজ্ব থেকে ফিরলে উনার সাথে আলাপ করে রমা চৌধুরী স্মৃতি সংরক্ষণে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

চেরাগী পাহাড় মোড়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে রমা চৌধুরীকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

বেলা সোয়া ১টার দিকে রমা চৌধুরীকে বহকারী অ্যাম্বুলেন্সটি ধীরে ধীরে ছেড়ে যায় তার প্রিয় অঙ্গন চেরাগী পাহাড়।

এখানকার লুসাই ভবনের চতুর্থ তলার বাসাটি থেকেই খালি পেয়ে হেঁটে তিনি যেতেন নানা গন্তব্য নিজের রচিত বই বিক্রি করতে।

মুক্তিযুদ্ধের হারানো সন্তানদের ঠাঁই হওয়া মাটিতে আর কখনোই জুতা পায়ে হাঁটেননি এই বীরাঙ্গনা।

তার ইচ্ছা অনুসারে শেষ ঠিকানা হবে বোয়ালখালীর পোপাদিয়া গ্রামে, সেখানেই সমাহিত করা হবে তাকে। যেখানে শুয়ে আছেন রমা চৌধুরীর তিন সন্তান।