সদ্য জামিনে মুক্ত ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি এই দাবি করার পাশাপাশি বোয়ালখালী থানা হাজতে তার উপর নির্যাতনের অভিযোগও তুলেছেন।
বোয়ালখালীর ওসি হিমাংশু দাশ রানাসহ থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তার।
সমর চৌধুরীকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন ওসি হিমাংশু দাশ। গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে সোমবার রাতে হিমাংশু দাশের মোবাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এরপর বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ধরনের অভিযোগ আমিও পেয়েছি। মৌখিকভাবে অভিযোগ দিয়েছেন সমর চৌধুরী।”
অভিযোগ তদন্তের জন্য অতিরিক্ত এসপি (চট্টগ্রাম দক্ষিণ) এবং অতিরিক্ত এসপি (পটিয়া সার্কেল)কে দায়িত্ব দিয়েছেন জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সমর চৌধুরী চট্টগ্রাম শহরে থাকলেও তার বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলার দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামে। ওই গ্রামের লন্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশের সঙ্গে তার কাকা স্বপন দাশের জমি নিয়ে বিরোধ আছে। স্বপন দাশকে আইনগত পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন সমর চৌধুরী।
ওই ঘটনার জের ধরে ‘সঞ্জয় দাশের প্ররোচনায়’ চট্টগ্রাম রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি মনির-উজ-জামানের ‘নির্দেশে’ সমরকে গত ২৭ মে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এরপর তাকে ইয়াবা ও অস্ত্র মামলার আসামি করা হয়।
সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যে সমর চৌধুরীকে ইয়াবা আটকের মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। এই অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রশ্ন তুলে আসছে।
সমর চৌধুরীকে ঘটনাটি প্রকাশ পেলে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এর মধ্যেই ডিআইজি মনির-উজ-জামানকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এদিকে দুই মামলায় জামিন নিয়ে গত ১২ জুলাই কারাগার থেকে মুক্তি পান সমর চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম শহরের বাসায় সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
তিনি জানান, গত ২৭ মে সন্ধ্যায় কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে আদালত ভবনের নিচে একটি হোটেলে ছিলেন তিনি। ওই সময় বোয়ালখালী থানার এসআই আরিফুর রহমান ও এসআই আতিক উল্লার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তাকে ধরে নিয়ে যায়।
প্রথমে থানায় নিয়ে পুলিশ তার হাতে থাকা একটি স্বর্ণের ও একটি রুপার আংটি, মোবাইল সেট, নগদ ১২ হাজার টাকা ও মানিব্যাগ নিয়ে হাজতে আটকে রাখে বলে জানান তিনি।
সমর অভিযোগ করেছেন, ওই সময় তার কয়েকজন স্বজন থানায় গেলেও তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, “রাতের বেলায় আমি ওসি হিমাংশু দাশকে দেখে তার পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করি। তাকে বলি, তার দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী স্বপন দাশের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখিনি। এসময় ওসি হিমাংশু আমাকে লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলে মাথা ফেটে যায়।”
ওসি কবে স্বপন দাশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে মানা করেছিলেন, জানতে চাইলে সমর বলেন, “গত বছরের শেষ দিকে ওসি থানায় যোগদান করার পর আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। ওই সময় একটি কাগজ দেখিয়ে বলে, ‘ডিআইজি আপনার নাম, স্বপন দাশ ও বাপন দাশের নাম দিয়েছে। সেখানে আপনার নাম লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়েছে। আপনার নাম প্রথমে আছে’।”
২৭ মে রাত ১টার পর থানা হাজত থেকে তাকে বের করে নেওয়া হয়েছিল জানিয়ে সমর বলেন, প্রথমে গামছা দিয়ে তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে গালাগালি করা হয় তাকে।
“ওসি হিমাংশু বলে, ‘শালাকে ফেলে দিয়ে আয়’। এরপর হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে আমাকে গাড়িতে তোলা হয়। ওইসময় আমি আমার মেয়ে ও স্ত্রীর কী হবে বলে আকুতি করলে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।”
গাড়িতে করে তাকে চরণদ্বীপ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে জানান সমর। চোখ বাঁধা অবস্থায় কী করে চরণদ্বীপ বুঝলেন- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ড্রাইভার কোথায় যাবে জানতে চাইলে তাকে বলেছিল, চরণদ্বীপ নিয়ে যেতে।”
ওই গাড়িতে পাঁচজন পুলিশ সদস্য ছিলেন বলে জানান তিনি।
“আমি হ্যান্ডকাফটা একটু হাল্কা করে দিতে বললে একজন বলে, ‘আর দুই/তিন মিনিট আছে। তারপর তোকে তো বেহস্তে পাঠিয়ে দেব’।
“চরণদ্বীপ এলাকায় নিয়ে গিয়ে আমার চোখ খুলে দিয়ে চলে যেতে বলে। ওই সময় আমার মনের মধ্যে ভয় চলে আসে। আমি না গিয়ে তাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকি এবং ঠাকুরের নাম জপ করতে থাকি।”
না যাওয়ায় তখন এক পুলিশ সদস্য লাঠি দিয়ে হাঁটুতে আঘাত করেন বলে জানান সমর। হাঁটুতে সেই জখমের চিহ্নও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেখান তিনি।
সমর বলেন, “ওই সময় এসআইর মোবাইলে একটি ফোন আসলে তিনি আমার কাছ থেকে দূর সরে গিয়ে ফোনে কথা বলেন। কথা শেষ করে এসে আবার চোখ বন্ধ করে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে গাড়িতে তোলেন।”
সেখান থেকে সরোয়াতলী এলাকায় বাড়িতে নিয়ে পুলিশ ইয়াবা উদ্ধারের ‘গল্প সাজায়’ বলে সমর জানান। বাড়ি থেকে আবার থানায় নেওয়া হয় তাকে।
সমর বলেন, থানা হাজতে নেওয়ার পর তিনি পানি চাইলে এক এসআই তাকে ‘প্রস্রাব খাওয়াতে’ চেয়েছিলেন। হাজতে থাকা আরেকজন পানি দিতে চাইলে তাকেও মারধর করা হয় ।
“থানায় নিয়ে যাওয়ার পরদিন বিকাল পর্যন্ত আদালতে না পাঠানোতে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওসিকে ফোন করে দ্রুত আমাকে চালান করার কথা বলেন। না করলে আইনজীবীরা থানায় যাবেন বলায় ওসি তড়িঘড়ি করে আমাকে চালান করে,” বলেন তিনি।
‘হাতে অস্ত্র দিয়ে জোর করে’ তোলা হয় ছবি
আদালতে নেওয়ার আগে হাজত থেকে বের করে একটি টেবিলে কিছু লাল রঙের ট্যাবলেট সাজিয়ে রেখে ছবি তোলা হয়েছিল বলে দাবি করেন সমর চৌধুরী।
তিনি বলেন, এক যুবক সাংবাদিক পরিচয়ে ঢুকে তার ক্যামেরা দিয়ে এক এসআইকে ছবি তুলতে বলেন। এরপর অস্ত্র হাতে ধরিয়ে ছবি তোলা হয়।
“আমি পুলিশের কথা মতো হাতে অস্ত্র নিতে অপারগতা জানালে এক পুলিশ সদস্য আমাকে পায়ে লাথি পারে। তখন পাশে দাঁড়ানো দুই কনস্টেবল আমার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার পর সে ছবিটি পুনরায় তোলে।”
পকেটে কলম, হাতে অস্ত্র নিয়ে সমর কৃষ্ণের ছবি গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়ে আসছিল চট্টগ্রামজুড়ে।
অস্ত্র ও মাদকের দুটি মামলায় জামিন পেলেও সমর চৌধুরীর পুরো পরিবার এখন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
তার দুই মেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকায় এখনও পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যত নিয়ে তারা শঙ্কিত।