ঢলের পানিতে শিল্পবর্জ্য: হালদায় ‘অশনি সংকেত’

ঢলে ভেসে আসা শিল্পবর্জ্য মিশে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীর সাম্প্রতিক দূষণকে ‘স্মরণকালের ভয়াবহ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে হালদা নদী রক্ষা কমিটি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2018, 09:04 AM
Updated : 29 June 2018, 10:02 AM

শুক্রবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনজুরুল কিবরিয়া একে হালদা নদীর জন্য ‘অশনি সংকেত’ বলেছেন।

টানা কয়েক দিনের অতিবৃষ্টি ও পাহড়ি ঢলের কারণে শিল্পবর্জ্য মিশে দূষিত হচ্ছে হালদা। আশপাশের বসতিতে এ শিল্পবর্জ্য ঢুকে পড়ায় পুকুরের মাছ মরে যাচ্ছে, ফসলী জমি নষ্ট হচ্ছে বলে তথ্য দেন হালদা রক্ষা আন্দোলনকারীরা।

এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “গত ১৯ জুন রাত থেকে এই দূষণ শুরু হয়। এরপরের দুইদিন হালদা এবং এর অববাহিকার বিলগুলোতে ব্যাপক হারে মাছ মরে ভেসে উঠেছে।”

নদীর বিভিন্ন অংশের পানির নমুনা সংগ্রহ করার পর তা পরীক্ষা করে অক্সিজেনের মাত্রা কম ও অ্যামোনিয়ার মাত্রা ভয়াবহ হারে বেশি পাওয়ার কথা জানান তিনি। 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রতি লিটার পানিতে স্বাভাবিকভাবে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে অন্তত পাঁচ মিলিগ্রাম। কিন্তু সংগ্রহ করা পানির নমুনায় অক্সিজেনের মাত্রা পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ২১ থেকে এক দশমিক শূন্য মিলিগ্রাম পর্যন্ত।  আর হালদার পাশের খন্দকিয়া খালে দ্রবীভূত অ্যামোনিয়া পরিমাণ স্বাভবিকের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি।

দ্রবীভূত অক্সিজেন কমার পাশাপাশি ও অ্যামোনিয়ার বিষক্রিয়াই হালদা নদীতে মাছ মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছে মনজুরুল কিবরিয়া।

“পানির উপরের অংশে বাতাসের কারণে কিছুটা অক্সিজেন থাকলেও তলদেশে ছিল না। এজন্য তলদেশের মাছ বেশি মারা গেছে।”

এই হালদা গবেষক বলেন, নানা রকম দূষণের পরও এ বছর হালদা নদীতে রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হওয়ায় মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু তার তিন মাসের মাথায় এ দূষণ ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটিয়েছে; মানুষ এখন উদ্বিগ্ন।

হালদা নদী রক্ষা কমিটির এই সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত মতামত গ্রহণের মাধ্যমে দূষণ ও বিপর্যয়ের সঠিক কারণ উদঘাটন ও হালদাবান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানানো হয়।

এর আগে গত শনিবার মদুনঘাটে হালদা পাড়ে এক মানববন্ধনে বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি এলাকার মানুষও হালদা নদীর পাশাপাশি সংযুক্ত সাতটি খাল দূষণমুক্ত করার দাবি জানায়।

বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্স ল্যাররেটরি ও বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় হালদা রক্ষা কমিটি গত ২১ থেকে ২৫ জুন নদীর বিভিন্ন অংশের পানির নমুনা সংগ্রহ ও মৃত মাছ সংগ্রহ করে।  

তাদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সংবাদ সম্মেলনে হালদায় দূষণের চারটি সম্ভাব্য চারটি উৎসের কথা তুলে ধরেন মনজুরুল।

তিনি হাটহাজারি ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যন্ট; নন্দীর হাটের এশিয়ান পেপার মিলস; চৌধুরী হাট, ফতেয়াবাদ, বড়দিঘী, নন্দীর হাট এলাকায় ব্যাপক হারে গড়ে উঠা পোল্ট্রি ফার্মের বর্জ্য ডাম্পিংকে হালদার সাম্প্রতিকে দূষণের জন্য দায়ী করেন।  

পাশাপাশি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনন্যা আবাসিক এলাকা নির্মাণ কাজ চলাকালে বামনশাহী খাল বন্ধ করে দেয়াকেও তিনি দায়ী করেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বামনশাহী খাল বন্ধ করে দেওয়ায় কয়েক কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

আগে অক্সিজেন থেকে কুলগাঁও পর্যন্ত এলাকার শিল্পবর্জ্য বামন খালের মাধ্যমে কর্ণফূলীতে যেত। খাল ভরাট হওয়ায় এ বছর অতিবৃষ্টিতে বিপরীতমুখী প্রবাহ সৃষ্টি হয়ে হাটহাজারি উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নসহ পাশ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বর্জ্য মিশ্রিত পানি ঢুকে পড়েছে। পাশাপাশি খন্দকিয়া ও কাটাখালী খাল হয়ে মদুনাঘাট এলাকায় হালদা নদীতে গিয়ে মিশছে।

হালদা নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে। হাটহাজারি পিকিং পাওয়ার প্লান্ট, এশিয়ান পেপার মিলসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ইটিপি স্থাপনে বাধ্য করা, হাটহাজারি মরা খালে পোল্ট্রি বর্জ্য ডাম্পিং স্থায়ীভাবে বন্ধ করার দাবি জানানো হয় সেখানে।  

হালদা নদী রক্ষার স্বার্থে আবাসিক এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এসটিপি স্থাপন করা ছাড়াও ‘বামনশাহী খাল পুনঃখনন করে অনন্যার মাস্টার ড্রেনেজ সিস্টেমকে বামনশাহী ও কুয়াইশ খাল থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয় সুপারিশে।

অন্যদের মধ্যে হালদা রক্ষা কমিটির উপদেষ্টা সাংবাদিক শামসুল হক হায়দারী, সহ-সভাপতি চৌধুরী ফরিদ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী, রেজা মুজাম্মেল, আমিন মুন্না সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

আরও খবর