অভিযান হলে বদলায় ‘মাদক আখড়া’ বরিশাল কলোনির নিয়ন্ত্রণ

চট্টগ্রাম নগরীর বরিশাল কলোনির মালিপাড়ায় গত বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাবের অভিযানে নিহত হয়েছিলেন দুই মাদক বিক্রেতা। দুদিন বাদে সেখানে অভিযান চালিয়ে আবার তিনজন মাদক বিক্রেতাকে ধরেছে পুলিশ।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2018, 01:57 PM
Updated : 20 May 2018, 01:57 PM

তবে বৃহস্পতিবার যারা নিহত হয়েছিলেন, গ্রেপ্তার তিনজন তাদের প্রতিপক্ষ দলের বলে পুলিশ জানিয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অভিযান হলেই নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তন হয় বন্দর নগরীর মাদক আখড়া হিসেবে পরিচিত বরিশাল কলোনির। তবে তা ঘুরে-ফিরে থাকে দুই পক্ষের হাতে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভিযানের সময় নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষ কোণঠাসা হয়ে পড়লে সেই সুযোগে অন্য পক্ষ নিয়ন্ত্রণে আসে। তখন কোণঠাসা পক্ষ সুযোগ খোঁজে নতুন অভিযানের।

চট্টগ্রাম রেল স্টেশনের পাশে সদরঘাট থানার আইস ফ্যাক্টরি রোডে বরিশাল কলোনি মাদক সেবী ও বিক্রেতাদের আখড়া হিসেবে নগরবাসীর কাছে পরিচিত।

বৃহস্পতিবারর র‌্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে হাবিবুর রহমান ও মো. মোশারফ নিহত হওয়ার পর বরিশাল কলোনির মালিপাড়া থেকে শনিবার রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে মো. হানিফ ওরফে খোকন (৩৫), কাজী মো. আব্দুল্লাহ (২৮) ও খোকন কুমার দাশকে (৩২)।

শনিবার রাতে বরিশাল কলোনি থেকে গ্রেপ্তার হানিফ ওরফে খোকন, কাজী মো. আব্দুল্লাহ ও খোকন কুমার দাশ

পুলিশ বলছে, এই তিনজন গত বছর র‌্যাবের বন্দুকযুদ্ধে নিহত তালিকাভুক্ত মাদক বিক্রেতা মো. ফারুক ওরফে বাইট্টা ফারুকের অনুসারী। ফারুকের ছোট ভাই শুক্কুর গত শুক্রবার বরিশাল কলোনির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

সদরঘাট থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রেপ্তার খোকন বন্দুকযুদ্ধে নিহত ফারুকের গাড়িচালক ছিল। ফারুকের মৃত্যুর পর ও ইয়াবা ব্যবসার সিন্ডিকেটের সাথে সম্পৃক্ত হয়। গ্রেপ্তার হওয়ারা সবাই ফারুকের ছোট ভাই শুক্কুরের হয়ে কাজ করছে।”

তিনি জানান, মালিপাড়া রেলওয়ে ৯ নম্বর কোয়ার্টারের ভেতরের রাস্তায় অভিযান চালায় সদরঘাট থানা পুলিশের একটি দল। ওইসময় সেখান থেকে ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন, তিনটি কিরিচ, ৬২৩টি ইয়াবা এবং ইয়াবা ও মাদক সেবনের বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।

“অন্যপক্ষ থেকে বাঁচতে তারা সবসময় সেখানে অস্ত্র মজুদ রাখে,” বলেন সদরঘাট থানার ওসি নেজাম। 

পুলিশ জানিয়েছে, র‌্যাবের অভিযানের সময় ওই এলাকার দেখভাল করছিল সালামত ও নাছির। বৃহস্পতিবার তারা পালিয়ে গেলে শুক্কুর তার দলবল নিয়ে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।

রেল স্টেশনের পাশে সীমানা প্রাচীর ঘেরা জায়গা বরিশাল কলোনি রেলওয়ের মালিকানাধীন; ওই এলাকায় বাস করে নিম্ন আয়ের বিভিন্ন মানুষ।

স্থানীয়রা জানায়, বরিশাল কলোনিতে খুপড়ি করে নিয়মিত চলে মাদক বেচাকেনা ও সেবন। বিভিন্ন স্থানে মাটি খুঁড়ে রাখা হয় মাদক। সেসব খুপড়িগুলো মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের কাছে ‘গিরা’ নামে পরিচিত। 

বরিশাল কলোনির আখড়ায় এরবম গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা হয় ফেনসিডিল (ফাইল ছবি)

বরিশাল কলোনি সংলগ্ন বাস্তুহারা কলোনি ধোপার মাঠ, মরিচ্চাগলিতেও মাদক বেচা-কেনা হয় প্রকাশ্যে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে ওই এলাকায় অভিযান চালালেও মূল বিক্রেতারা থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

সেখানে অভিযানে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। মাদক ব্যবসার আধিপত্য ও ভাগ ভাটোয়ারা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুন হয়েছে অনেকে। 

পুলিশ ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যে বরিশাল কলোনির মাদক আস্তানার হোতা হিসেবে ঘুরে ফিরে আসে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গত বছর নিহত ফারুক ও ইউসুফের নাম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৯০’র দশকে বরিশাল কলোনিতে মাদক বিক্রির নিয়ন্ত্রণ ছিল রফিক নামে এক ব্যক্তির হাতে। তার সঙ্গী ছিলেন মনির, ফারুক, সালামত, নাছির, ইউসুফ, হোন্ডা বাহার ও সিএনজি জসীম।

গত বৃহস্পতিবার অভিযানের সময় পাওয়া গিয়েছিল এসব মাদক

দশক কাল আগে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে রফিককে সরিয়ে দিয়ে আস্তানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল মনির ও তার সহযোগী ফারুক। এরপর ফারুক-মনিরের দ্বন্দ্ব শুরু হলে সালামত, নাছির থাকেন ফারুকের পক্ষে; বেলাল, বাহার ও নয়ন যোগ দেন মনিরের সঙ্গে। ২০১২ সালের দিকে নয়ন খুন হন অভ্যন্তরীণ বিরোধে।

স্থানীয়রা জানায়, ফারুক ও মনিরের দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে একসময় আখড়ার একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেন ইউসুফ। তবে ২০১৬ সালের মনির ‘নিখোঁজ’ হলে ফারুক অনেকটা একক নিয়ন্ত্রণ নেন বরিশাল কলোনির।

ফারুক প্রথম দিকে ইউসুফের সঙ্গে বড় কোনো বিরোধে না জড়ালেও কিছুদিন পর খসরু নামে একজনকে নিয়ে ফারুক ও ইউসুফের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। গত বছরের ২০ অক্টোবর র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ফারুক।

পুলিশ জানায়, ফারুক মারা যাওয়ার পর তার ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেয়। ফারুকের স্ত্রী ও শ্যালক রানার সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় তার ছোট ভাই শুক্কুরের।

ফারুকের স্ত্রী ও শ্যালক তখন নাছির, সালামতের সঙ্গে মিলে ইউসুফের দলে ভেড়েন। আর খসরুর সঙ্গে যোগ দেন শুক্কুর। গত বছরের নভেম্বরে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন খসরু।

নাম প্রকাশ না করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারাগারে থাকলেও খসরু সেখানে বসে মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করে বরিশাল কলোনির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চালায়।”

ইউসুফ বর্তমানে ভারতে পালিয়ে আছেন বলে তার অনুসারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। তার হয়ে  নাছির-সালামত বরিশাল কলোনিতে কর্তৃত্ব করতেন, তাদের সঙ্গে ছিলেন ফারুকের স্ত্রী।

গত বৃহস্পতিবার অভিযানের সময় নিহত একজন

স্থানীয়রা জানান, নাছির-সালামতের হয়ে মাদক স্পট দেখাশোনা করতেন গত বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাবের অভিযানে নিহত মোশারফ ওরফে মুসা। মুসা নিহত হওয়ার পর তার পক্ষের লোকজন পালিয়ে যায়।

সদরঘাট থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি, মুসা নিহত হওয়ার পর শুক্কুরের নেতৃত্বে সিরাজ, মালেক, রাজু, হেলাল, ল্যাংরা শাহজাহান, টুনা জুয়েল, লোকমান, কালা মনির, ট্যাংরা কাশেম মিলে বরিশাল কলোনির মালিপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়।”

গ্রেপ্তার তিনজনের পাশাপাশি শুক্কুরসহ অন্যদের পলাতক আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।