ধাক্কায় হারিয়ে গেল ছোট বোন

ইফতার সামগ্রী নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে ছোট বোন নূরজাহানের হাত ধরেই ছিলেন রাজিয়া বেগম। কিন্তু ভিড়ের চাপে ধাক্কাধাক্কিতে ছুটে যায় বোনের হাত।

মিন্টু চৌধুরী সাতকানিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2018, 03:44 PM
Updated : 14 May 2018, 04:44 PM

রাজিয়া পরে অবশ্য ছোট বোনকে পেয়েছেন, তবে লাশের সারির মধ্যে।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা (হাঙ্গরমুখ) এলাকার কাদেরীয়া মুঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা মাঠে সোমবার ইফতার সামগ্রী নিতে গিয়ে ভিড়ের চাপে মারা যান নয়জন নারী। তাদের মধ্যে ২২ বছর বয়সী নূরজাহানও একজন।

কবির স্টিল রি-রোলিং মিল (কেএসআরএম) নামের ইস্পাত কারখানার মালিকের পক্ষে ওই মাদ্রাসা মাঠে প্রতিবছরের মত এবারও ইফতার সামগ্রী ও নগদ টাকা বিতরণের আয়োজন করা হয়েছিল।

ইফতার ও টাকা বিতরণের খবর পেয়ে শুধু সাতকানিয়াই নয়, বাঁশখালী, চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া উপজেলা এবং বান্দরবান ও কক্সবাজার থেকেও দুস্থরা সেখানে জড়ো হয়েছিল বলে স্থানীয়রা জানান। রোববার গভীর রাত থেকেই মাদ্রাসার মাঠে জড়ো হতে থাকেন মানুষ।

প্রায় ২০ হাজার মানুষকে ইফতার সামগ্রী বিতরণের জন্য মাদ্রাসা মাঠে বাঁশের বেষ্টনি দিয়ে একাধিক স্থান নির্ধারণ করা হয়।

নিহতদের স্বজনের আহাজারি।ছবি: সুমন বাবু

মাদ্রাসার মূল ফটক দিয়ে ভেতর ঢুকতেই ডান পাশে সেরকম একটি নির্ধারিত স্থানে ছোট বোন নূরজাহানকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রাজিয়া বেগম।

রাজিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত (রোববার) রাত ৯টার সময়ই মাঠে চলে আসি। সকালে লাইনে দাঁড়িয়ে যাই।

“তখন নূরজাহানের হাত আমার হাতে ধরা ছিল। পেছন থেকে হঠাৎ জোরে ধাক্কা লাগে। এসময় হাত ছুটে যায়। ধাক্কায় আমিও মাটিতে পড়ে যাই। আমি পরে উঠতে পারলেও বোনকে আর খুঁজে পাইনি।”

পরে মাদ্রাসার কক্ষে লাশের সারিতে রাজিয়া খুঁজে পান বোনের নিথর দেহ। বোনের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে আসেন অটোরিকশা চালক ভাই আলী আহমদও।

তাদের আহাজারি আর কান্নায় ছিল শুধু বোন হারানোর বেদনা। নিহত নূরজাহান দুই সন্তানের জননী। 

লণ্ডভণ্ড মুঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার মাঠ ।ছবি: সুমন বাবু

চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী জামাল মেম্বার বাড়ির আনোয়ারা বেগমের (৬০) স্বামী মারা গেছেন আগেই। একমাত্রও মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। ভরণপোষণ দিত জামাতা।

নিহত আনোয়ারা বেগমের বেয়াইন আসমা খাতুন থাকেন খাগরিয়া। বেয়াইনের মৃত্যুর খবরে তিনি ছুটে আসেন নলুয়ায়।

আসমা খাতুন বলেন, “উনি যে ইফতার সামগ্রী নিতে এসেছেন সেটা আমার ছেলে বা ছেলে বউ কেউই জানত না। কাল রাতে কাউকে না জানিয়ে তিনি এখানে চলে আসেন।”

ইস্পাত প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম সিইও মেহেরুল করিমের ভাষ্য, মাদ্রাসার মাঠে ২০ হাজার লোককে ইফতার সামগ্রী এবং নগদ এক হাজার করে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।

স্থানীয়রা জানান, মাঠে ছিল প্রচণ্ড ভিড়। আর সকাল থেকে ছিল তীব্র রোদ।

ভিড়ের চাপে আহত বাঁশখালী উপজেলার বাসিন্দা আঙ্গুর জাহান (৫০) ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “এলাকার মহিলাদের সাথে ভোর রাতে এখানে আসি। মানুষের ঠেলায় একজন আরেকজনের উপর পড়ে গেছে।”

লণ্ডভণ্ড মুঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার মাঠ ।ছবি: সুমন বাবু

আঘাত পাওয়া ডান হাত দেখিয়ে তিনি বলেন, “কোনো সাহায্য পাইনি, টাকাও পাইনি। হাত ছিঁড়ে গেছে, এখন বাড়ি যাব কীভাবে?” 

সাতকানিয়ার মক্তিয়ারকুম এলাকার বাসিন্দা সালমা বেগম (৪০) জানান, মাঠে পানি ও শরবত দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে ধাক্কাধাক্কিতে এই ঘটনা ঘটে।

ভিড়ের চাপে প্রাণ হারিয়েছেন সাতকানিয়ার উত্তর ঢেমশার আবুল কালামের স্ত্রী সাকি আক্তার (২২)। তার তিন বছর বয়সী একটি ছেলে আছে।

সাকির ভাই তানভীর হোসেন বলেন, “স্বামীকে না জানিয়ে রাত তিনটার দিকে পাড়ার মহিলাদের সাথে বোন এখানে চলে আসে। তার খবর পাই আজকে দুপুরে।”

কেএসআরএম প্রতিবছর রমজান উপলক্ষে দুস্থদের মধ্যে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করে।

এবারের আয়োজনেও সকাল থেকে মাদ্রাসা মাঠে মেডিকেল টিমের ব্যবস্থা ছিল বলে তাদের দাবি।