চট্টগ্রাম না দেখলে বাংলাদেশে আসাটা পূর্ণ হত না: প্রণব

বন্দরনগরীতে গিয়ে অভিভূত প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা চট্টগ্রামে না গেলে তার বাংলাদেশ সফর পূর্ণতা পেত না।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2018, 04:29 PM
Updated : 16 Jan 2018, 04:57 PM

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বর্ষীয়ান নেতা প্রণবকে মঙ্গলবার সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি দেয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

রাতে নগরীর র‌্যাডিসন হোটেলে ভারতীয় হাই কমিশন আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম না দেখলে বাংলাদেশে আসাটা বোধ হয় সম্পূর্ণ হয় না। তার অন্যতম কারণ, এটি দেশের একটি প্রধান বন্দর।

“শুধু তাই নয়, যেমন অবিভক্ত ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনে চট্টগ্রামের মানুষের একটা বিপুল ভূমিকা ছিল, ঠিক তেমনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেও চট্টগ্রামের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়।”

এই অনুষ্ঠানের আগে বিকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মভিটা রাউজানের নোয়াপাড়ায় যান প্রণব মুখোপাধ্যায়।

অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে। এবং মুজিবুর রহমানের ঘোষণা তার গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, সেটা পৃথিবীর মানুষের নজরে এনেছিলেন সেই বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা।

“তখন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে সময় নিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিল। আমরা জানি বেতারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে, সেখানে একটুও শিথিল হয় না। অথচ বেতার থেকেই সেই ঘোষণা প্রচার হয়।”

প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, “ইচ্ছে ছিল চট্টগ্রামে একবার যাব। বয়স হয়ে যাচ্ছে। না গেলে হয়ত আর যাওয়া হবে না। আল্লাহর ইচ্ছায়, ঈশ্বরের করুণায় তা হল।”

এই কংগ্রেস নেতা বলেন, একটা দেশের স্বাধীনতা, তার স্বজাত্য বোধ গড়ে উঠতে সময় লাগে। বাংলাদেশও সময় নিয়েছে, তবে সময়টা অনেক কম।

“পাকিস্তান সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের সম্পূর্ণ সংযুক্তি তো পাকিস্তানের সাথে হয়নি। প্রথম থেকেই একটা বাধা রয়ে গিয়েছিল, সেটা ভাষা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে।”

বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, অবিভক্ত পাকিস্তানের স্রষ্টা কায়েদে আজম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বললেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কিন্তু কায়েদে আজমের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলে বলেছিলেন- ‘না’।

“বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। সঙ্গত কারণেই। পাকিস্তানের অর্ধেকের বেশি মানুষ ছিল তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের, সুতরাং তাদের ভাষা কেন রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাবে না? স্বাধীন হওয়ার পরেও এটা মেনে নেওয়া যায় না।”

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সাহসী ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাকিস্তানের কনস্টিটিউশন এসেম্বলির প্রথম অধিবেশনে এই দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। তখনকার কংগ্রেস নেতা পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কুমিল্লার) এটা প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন।

“কেন বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করা হবে? সেজন্য তাকে অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। সেদিনই তাকে বলা হয়েছিল, তুমি পাকিস্তান ভাগ করার চেষ্টা করেছ ভাষার প্রশ্নে?”

ভাষাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সেই স্বজাত্য বোধের প্রকাশ স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে মন্তব্য করে প্রণব বলেন, “আপনারা স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ। আপনাদের সকলকে প্রগতি ও উন্নয়নের জন্য ধন্যবাদ।”

এই উপমহাদেশে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য মানুষে মানুষে সম্পর্কের ওপর জোর দেন তিনি।

“এই সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই দুটি বা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। আমরা সকলেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধিবাসী। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আরেকটা বৃহত্তর পরিচয় আছে, সেটা হচ্ছে, আমরা মানুষ।”

প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই বিশ্বজনীনতা, আমি বিশ্বের অন্যতম অংশ, যত ক্ষুদ্র অংশই হই। আমাকে বাদ দিয়ে বিশ্ব নয়। সেই ইউনিভার্সালিজম সেটাই আমাদের সমাজ রাষ্ট্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে নগরীর চাবি তুলে দেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

‘প্রীতলতা ট্রাস্টের’ নেতৃবৃন্দের হাতে ছয় লাখ ২৮ হাজার টাকার চেক তুলে দেন প্রণব।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে শমিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়, একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনের সাংসদ, বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা ও পত্রিকার সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।