মহিউদ্দিনের কুলখানির মেজবানে পদদলিত হয়ে নিহত ১০

চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির মেজবানে ভিড়ের মধ্যে পদদলিত হয়ে অন্তত দশ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীও উত্তম সেনগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2017, 08:40 AM
Updated : 19 Dec 2017, 06:15 AM

সোমবার দুপুরে নগরীর জামালখান আসকার দীঘির পাড়ে রীমা কমিউনিটি সেন্টারে এ ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ১১ জন।

চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গভীর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। প্রায় ১৬ বছর চট্টগ্রামের মেয়রের দায়িত্ব পালন করা এই রাজনীতিবিদ স্থানীয়ভাবে ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়।

তার কুলখানির জন্য সোমবার পরিবারের পক্ষ থেকে নগরীর ১৩টি কমিউনিটি সেন্টারে মেজবানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।  অমুসলিম এবং যারা গোমাংস খান না, তাদের জন্য মেজবানের ব্যবস্থা হয়েছিল ওই রীমা কমিউনিটি সেন্টারে।

দুই তলা ওই কমিউনিটি সেন্টার ভবনের নিচতলায় মূলত গাড়ি রাখা হয়। বসা ও খাওয়ার ব্যবস্থা দোতলায়। আসকার দীঘির পাড় কিছুটা নিচু এলাকা হওয়ায় ওই এলাকার অধিকাংশ ভবনের মত রীমা কমিউনিটি সেন্টারের প্রবেশ পথও বেশ খানিকটা ঢালু। সেখানেই ভিড়ের মধ্যে পদদলনের ঘটনা ঘটে।

এ আয়োজনে রীমা কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন আন্দরকিল্লার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নগর আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক জহরলাল হাজারী।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, তারা ১৩ হাজার লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। দুপুরে খাবার পরিবেশন শুরু হওয়ার পর তিনটি ব্যাচের খাওয়া শেষ হয়। একটি ব্যাচের খাওয়া তখন চলছিল। এরপর বসার জন্য অনেকে বাইরে অপেক্ষা করছিল।

“প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে এক সময় পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে লোকজন গেইট খুলে ঢুকতে শুরু করে। বিনা কারণে অধৈর্য্য হয়ে আগে ঢুকতে চাওয়ার জন্যই অত্যন্ত দুঃখজনক এ ঘটনা ঘটল।”

মেজবানে অংশ নিতে আসা অনুপ দাশ নামে একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফটকের বাইরে তখন অনেক মানুষের ভিড়। পেছনের চাপে সামনে ওই ঢালু জায়গায় থাকা বেশ কয়েকজন পড়ে যান। তখন তাদের ওপর দিয়েই পেছনের লোকজন হুড়মুড় করে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসাইন জানান, রীমা কমিউনিটি সেন্টারে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ২০ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন।

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে এত লোক হুড়মুড়িয়ে ফটক দিয়ে ঢোকা শুরু করে যে পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি বলে সেখানে দায়িত্বে থাকা একজন স্বেচ্ছাসেবক জানান।

ঘটনার পরপরই ওই কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার সাংবাদিকদের বলেন, অতিরিক্ত মানুষের ভিড়ের কারণে এবং ঢোকার সময় হুড়োহুড়ির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। অন্য কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।

জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী, নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, রাউজানের সাংসদ ফজলে করিম চৌধুরী এবং নগর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতা পদদলনের খবর পেয়ে দুপুরেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

রীমা কমিউনিটি সেন্টারের মূল ফটকে হুড়োহুড়ি থামাতে পুলিশকে মৃদু লাঠিপেটাও করতে হয়। পরে স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় টেম্পো ও অন্যান্য যানবাহনে করে হতাহতদের নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে এক আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

নিহতদের মধ্যে নয়জনের নাম জানাতে পেরেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা হলেন- কৃষ্ণপদ দাশ (৪৫), সুধীর দাশ (৫০), ঝন্টু দাশ পিন্টু (৪৫), প্রদীপ তালুকদার (৪৬), লিটন দেব (৪৩), দীপঙ্কর দাশ রাহুল (২৬), সত্যব্রত ভট্টাচার্য্য (৪২), অলক ভৌমিক (৩২) ও ধনা শীল (৬০)।

তাদের মধ্যে সত্যব্রত এলজিইডির লক্ষ্মীপুর কার্যালয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলী ছিলেন। আর দীপঙ্কর দাশ রাহুল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়ছিলেন।

কৃষ্ণপদ দাশ মাছ ধরার জাল বিক্রি করতেন। সুধীর দাশ ছিলেন জেলে। ঝন্টু দাশ পিন্টু নগরীর এপোলা শপিং সেন্টারের এক দোকানে চাকরি করতেন। প্রদীপ তালুকদার ঠিকাদারি  আর লিটন দেব ওষুধের দোকান চালাতেন।

ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান মহিউদ্দিন চৌধুরীর বড় ছেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক চৌধুরী মহিবুল হাসান নওফেল। সেখানে গিয়ে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লে পরে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।

রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, অসাবধানতাবশত এ ঘটনা ঘটনা ঘটেছে কি না, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু ছিল- তা তারা জানতে চান।

“এর আগেও আমাদের বাসায় এবং বিভিন্ন স্থানে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে। কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। রীমা কমিউনিটি সেন্টারে আগেও বহু মেজবান হয়েছে। তখনও কিছু হয়নি।”

ব্যারিস্টার নওফেল বলেন, অসাবধানতাবশত অপেক্ষমানদের মধ্যে থেকে কেউ রীমা কমিউনিটি সেন্টারের ফটক খুলে দিয়েছিল কি না তা দেখতে হবে।

“সেটা সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে। তদন্ত হলে জানা যাবে আসলে কী ঘটেছিল।”

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মাসুকুর রহমান সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রীমা কমিউনিটি সেন্টারের ঘটনা খতিয়ে দেখতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশ ঘটনার সময়ের ভিডিও সংগ্রহ করেছে এবং আলাদাভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি বিভাগের সহকারী কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন।

এদিকে রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিহতদের স্বজনরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তরের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। নগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তরের অনুমতি দিতে আহ্বান জানান।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাসুকুর রহমান সিকদার পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ‘বিধি মোতাবেক’ ব্যবস্থা নেবেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ টাকা এবং শেষকৃত্যের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এছাড়া আহতদের চিকিৎসা ব্যয়ও পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী।

এর আগে বাংলাদেশে পদদলনে হতাহতের দুটো বড় ঘটনা ঘটেছিল ২০১৫ সালে।

ওই বছর জুলাই মাসে ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে ২৭ নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়।

তার আগে মার্চ মাসে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী পুণ্যস্নানের সময় পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়।