লাখো জনতার মিছিলে শেষ যাত্রা মহিউদ্দিনের

বিকেলে সূর্য তখন হেলে পড়তে শুরু করেছে; লাখো মানুষের ভিড় ঠেলে চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে ঢুকল ফুল শোভিত অ্যাম্বুলেন্স।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2017, 06:00 PM
Updated : 15 Dec 2017, 06:03 PM

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বিদায় জানাতে আসা নেতা-কর্মী সমর্থকদের চোখে তখন অশ্রু।

সাড়ে পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে এই লালদীঘির মাঠেই বহু জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছেন তিন মেয়াদের মেয়র চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন। চট্টগ্রামের মানুষকে সংগঠিত করেছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন আর অসহযোগ আন্দোলনে।

লাখো জনতার অংশগ্রহণে সেই মাঠেই শুক্রবার বিকালে তার জানাজা পড়ান গরিবুল্লাহ শাহ মসজিদের খতিব মালওনা আনিসুজ্জামান।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী

হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

সকালে তার চশমা হিলের বাড়িতে মরদেহ নিয়ে যাওয়ার পর দুপুরে কফিন নেওয়া হয় দারুল ফজল মার্কেটে দলীয় কার্যালয়ের সামনে। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় লালদীঘি মাঠে।

জানাজার জন্য মাঠের পাশে পেট্রোল পাম্প চত্বরে তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী মঞ্চ। ওখানেই ছিল ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার। যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ।

কফিন বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ওই মাঠে পৌঁছানোর আগেই জনতার ভিড় নগর পুলিশের কার্যালয়, জেলা পরিষদ ভবন পেরিয়ে আদালত ভবন এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

আর অন্যদিকে লালদীঘির পাড় থেকে চট্টগ্রাম কারাগার হয়ে জেল রোড সড়ক, হকার মার্কেটের প্রবেশ পথ হয়ে সিনেমা প্যালেস এবং টেরি বাজারের মোড় পর্যন্ত সড়কে মানুষ দাঁড়িয়ে যায় জানাজায় অংশ নিতে।

বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটে মহিউদ্দিন চৌধুরী শেষবার হাজির হন জনতার মঞ্চে। একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধার কফিন ঢেকে দেওয়া হয় লাল-সবুজের জাতীয় পতাকায়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। পুলিশের একটি চৌকস দল সালাম জানায় প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাকে।

জানাজার নামাজের কাতারে তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বিএনপি নেতারাও।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাংসদ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি উপস্থিত ছিলেন জানাজার কাতারে।  

পরিবারের পক্ষে মহিউদ্দিনের বড় ছেলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, “আমার বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের মানুষ, দলের নেতাকর্মী, বিরোধী দলের নেতাকর্মী, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি- যারাই সহমর্মিতা জানিয়েছেন, সবার প্রতি ধন্যবাদ।”

আর বিকাল সোয়া ৪টার দিকে জানাজা শেষে মাওলানা আনিসুজ্জামান প্রশ্ন রাখেন- “আমাদের নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী কেমন লোক ছিলেন?”

সমবেত জনতা হাত তুলে চিৎকার করে বলে ওঠে- ‘ভালো লোক ছিলেন’।

তারপর মানুষের স্রোত যেন ভেঙে পড়তে চায় সেই মঞ্চের দিকে। প্রিয় নেতাকে শেষবার দেখার আকুতি আর ফুল দেওয়ার চেষ্টায় হাজারো জনতা এগিয়ে যায় কালো কাপড়ে মোড়া মঞ্চে, জাতীয় পতাকা জড়ানো কফিনের দিকে।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মরদেহ শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম শহরের মেয়র গলির বাসা থেকে নেওয়া হয় দলীয় কার্যালয়ে। এ সময় তার মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে চলে জনতার মিছিল। ছবি: সুমন বাবু

সরকার ও দলের পক্ষ থেকে ফুল দেওয়ার পর মহিউদ্দিনের মরদেহ তোলা হয় গাড়িতে। ফুলে ফুলে শোভিত সেই গাড়ি এগিয়ে চলে জনতার ভেতর দিয়ে।

চট্টগ্রামের মেয়র নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন ঘোষণা দেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে তারা শোকে মুহ্যমান। তাই বিজয় দিবস উপলক্ষে নগর আওয়ামী লীগের ১৫ ডিসেম্বরের সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হল।

বিএনপি নেতা ও মহিউদ্দিনের আত্মীয় আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, “হয়ত আমরা ভিন্ন দল করতাম। কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বির্নিমাণ ছিল তার সারাজীবনের সংগ্রাম।”

মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বহনকারী এম্বুলেন্স যখন নগরীর কাজীর দেউড়ি মোড় অতিক্রম করছে, পাশেই তখন আউটার স্টেডিয়ামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় বিজয়ের সুর বাজছে। ২৯ বছর আগে মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরেই চট্টগ্রামে বিজয় মেলার গোড়াপত্তন হয়েছিল।

সন্ধ্যায় চশমা হিল মসজিদে আরেক দফা জানাজার পর স্থানীয় কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে শায়িত হন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

আরও পড়ুন

মহিউদ্দিন চৌধুরী আর নেই

মানুষের অন্তরে মহিউদ্দিন বেঁচে থাকবেন: প্রধানমন্ত্রী

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতির শোক

মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ‘সকলের নেতা’

শোক মিছিলে শেষবার দলীয় কার্যালয়ে মহিউদ্দিন

চট্টগ্রামবাসীর মুখে মহিউদ্দিন বন্দনা

মহিউদ্দিনের মৃত্যুতে চট্টগ্রাম আ. লীগের ৩ দিনের শোক

মহিউদ্দিনের জন্য ‘কেঁদেছেন’ প্রধানমন্ত্রী  

বাবার কবরের পাশে শেষ ঘুমে মহিউদ্দিন চৌধুরী