‘হালদা’ টেনেছে চট্টগ্রামবাসীর মন

চেনা পরিবেশ, কাছ থেকে দেখা সেই সব মানুষের জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবি জনপ্রিয় তারকাদের অভিনয় ও সংলাপে উঠে এসেছে এলাকার ভাষায়-তাই ‘হালদা’ দেখতে হলমুখী হয়েছেন চট্টগ্রামের বাসিন্দারা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2017, 05:40 PM
Updated : 9 Dec 2017, 06:12 PM

হালদা পাড়ের জনজীবনের প্রকৃতি-প্রতিবাদ এবং প্রেম-প্রতিশোধের গল্প ছুঁয়ে গেছে এই দর্শকদের হৃদয়। তাই চট্টগ্রামের ভাষার ক্রিয়াপদের অসংলগ্ন ব্যবহার এবং প্রেমের দৃশ্যে চলিত ভাষার গান বাধা হতে পারেনি উপভোগের পথে।

হালদার প্রথম প্রদর্শনী উপলক্ষে শনিবার দুপুর থেকেই নগরীর আলমাস সিনেমা হল ঘিরে সপরিবারে দর্শকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিকাল ৩টার দিকে সেখানে এসে পৌঁছান ‘হালদা’ চলচ্চিত্রের পরিচালক তৌকির আহমেদ, অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা, রুনা খান, অভিনেতা সুজাত শিমুল, শাহেদ আলী সুজন ও সঙ্গীত শিল্পী পিন্টু ঘোষ।

তাদের সঙ্গে ছিলেন ‘হালদা’ চলচ্চিত্রের গল্পকার আজাদ বুলবুল, হালদা রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী।

ছবির পরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখতে এবং তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে আগেই হলের সামনের প্রাঙ্গণে জড়ো হন দর্শকরা। তখন নয়শ আসনের হল ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।

‘হালদা’ টিমকে শুভেচ্ছা জানাতে এসে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক এম এ সালাম বলেন, হালদা শুধু চট্টগ্রামের নয়, পুরো বাংলাদেশের সম্পদ। দূষণে আর অপরিকল্পিত গ্রহণের কারণে নদীর ক্ষতি হচ্ছে। হালদাকে বাঁচানো দরকার।

“নদী ও নারীর সামঞ্জস্যে এই গল্প আবর্তিত হয়েছে। ছবি দেখতে এসে সেই গানের কলি মনে পড়ছে, ‘এখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয়।”

সিনেমার গল্প শুরু হয়েছে সাগরে জেলে জীবনের বিপন্নতা দিয়ে। মা মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় জীবিকার খোঁজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দেন হালদার জেলেরা।

মনু মিয়ার (ফজলুর রহমান বাবু) জীবন বাঁচানোয় বদিউজ্জামানের (মোশাররফ করিম) ঠাঁই হয় হালদা তীরে। সেখানেই মনু মিয়ার মেয়ে হাসুর (তিশা) সঙ্গে দেখা বদিউজ্জামানের।

গল্প এগোতে থাকে হালদা ও হাসুর পরিবারকে ঘিরে। সঙ্গে হালদা তীরের জনপদের মাইজভান্ডারি গান, নাট্টো পোয়ার গান, বলি খেলা, নৌকা বাইচ, হালদায় ডিম সংগ্রহ এসব দৃশ্য দেখা যায় একের পর এক।

এর ব্যাখ্যা দিয়ে নির্মাতা তৌকির আহমেদ বলেন, “হালদার কথা বলতে গিয়ে এই এলাকার সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

“নদী যেমন বিপন্ন তেমনি আমাদের নারীরা এখনও সমাজে নিগৃহীত। হালদা- নদী ও নারীর গল্প। দর্শক ভীষণভাবে এই গল্পকে গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে তরুণ ও মধ্যবিত্ত সমাজ।”

এই সিনেমা দেখে মধুমতী, রূপসা, সাগরদাঁড়ি বা কপোতাক্ষ তীরের তরুণরা যদি তাদের নদী রক্ষায় সোচ্চার হয় তাহলে সেটাই হালদা নির্মাণের স্বার্থকতা বলে মন্তব্য করেন তৌকির।

হালদা তীরের ফটিকছড়ি উপজেলার অনেক বাসিন্দা শনিবার এসেছিলেন সিনেমাটি দেখতে।

তাদের একজন সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বাড়ির পাশে হালদা। এ নদী দিনে দিনে দখলে দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে।

“সেই কথা চলচ্চিত্রে কীভাবে এসেছে তা দেখতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসেছি। হালদাকে বাঁচানোর তাগিদ আমাদের সবার।”

সাগরে দস্যুর হাতে ট্রলার হারিয়ে বিপদগ্রস্ত মনু মিয়া বাধ্য হন হালদা তীরের ইটভাটার মালিক নাদের চৌধুরীর (জাহিদ হাসান) সাথে মেয়ে হাসুর বিয়ে দিতে। কিন্তু তার আগেই হালদা পাড়ের হাসু আর সাগর তীরের বদিউজ্জামানের মনের মিলন ঘটেছে।

নাদের চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়া হাসুর সংসার জীবনে তাই ঝড়ের আভাস।

দৃশ্যায়নে বারবার ফিরে আসে ঝড়ের রাত, হালদায় মা মাছ মারার পর বার বার মনু মিয়ার দুঃস্বপ্ন দেখা- প্রতীকী এসব দৃশ্যে নদী পাড়ের মানুষের জীবনের বিপন্নতাকেই ফুটিয়ে তোলে।

তবে সিনেমায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে ক্রিয়াপদের ভুল এবং অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার চট্টগ্রামের দর্শকদের কানে লেগেছে।

তিন বন্ধুর সঙ্গে হলে আসা আরিফুর রহমান বলেন, “এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা চট্টগ্রামের মানুষ সচরাচর ব্যবহার করে না। তবে হালদা নিয়ে নির্মিত ছবি দেখে আমরা খুশি।”

নির্মাতা তৌকির আহমেদ ও অভিনেত্রী তিশাও ভাষা নিয়ে প্রতিবন্ধকতার কথা স্বীকার করেছেন।

তৌকির বলেন, “আমরা চট্টগ্রামের ভাষাকে কিছুটা সহজ করেছি, যাতে সবাই বুঝতে পারে।”

তিশা বলেন, “যখন তৌকির ভাই বললেন পুরো ছবি হবে চট্টগ্রামের ভাষায় তখন সবার মুখ থেকে কথা সরে গিয়েছিল। সবাই যথা সম্ভব চেষ্টা করেছি। কষ্ট হয়েছে তবে এখন মনে হচ্ছে, কষ্ট স্বার্থক হয়েছে।”

গল্পের ঘটনাক্রমে বিপন্ন নদীর মতোই বিপন্ন হয়ে পড়ে হাসুর অনাগত সন্তানের জীবন।

হালদার মা মাছ রক্ষায় হাসু যেমন প্রতিবাদী, তেমনি নিজের অনাগত সন্তানকে রক্ষাও।

সিনেমার গল্পকার আজাদ বুলবুল বলেন, “মা-মাছ ও নারীর মাতৃত্বকে সমান্তরালভাবে দেখাতে চেয়েছি। উভয়ই আজ বিপন্ন। তাদের রক্ষার একটি আবেদন এই ছবির মাধ্যমে বলতে চেয়েছি।”

চলচ্চিত্রে নদী রক্ষার আন্দোলনে বন্ধ হয়ে যায় নাদের চৌধুরীর ইট ভাটা। নানা অনাচারে বিপন্ন নদী যেমন প্রতিশোধ নেয়, তেমনি নিজের মাতৃত্ব রক্ষায় প্রতিশোধ নেয় হাসু।

হালদার বুক চিরে নতুন ভোরে বয়ে চলা নৌকার বৈঠা তখন হাসুর হাতে। সেই ভোরে নতুন সূর্যের আলো যেমন হালদায় নতুন দিনের বার্তা দেয় তেমনি ‘হালদা’ চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তার আভাস দেয় চট্টগ্রামের হলে উপস্থিতি।  

দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে ফজলুর রহমান বাবু, তিশা, মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান, দিলারা জামান ও রুনা খানের অভিনয়।