ত্রিপুরা পাড়ার শিশুদের অসুস্থতার মূলে ‘দীর্ঘদিনের অপুষ্টি’

সীতাকুণ্ডের দুর্গম ত্রিপুরা পাড়ার শিশুরা দীর্ঘদিনের অপুষ্টির কারণে এক ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। 

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2017, 11:32 AM
Updated : 13 July 2017, 04:48 PM

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ত্রিপুরা পাড়ার ১৩ শিশুকে দেখার পর বৃহস্পতিবার আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমেদ ভুইয়া সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের মারাত্মক পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুদের শরীরে সহজে নানা ধরনের সংক্রমণ ঘটতে পারে।

“ওদের আর্থ সামাজিক অবস্থানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে তারা অপুষ্টিতে ভুগছিল। এ কারণেই তারা আক্রান্ত হয়েছে, প্রাথমিকভাবে এটাই আমাদের ধারণা।”

ডা. ফারুক জানান, অসুস্থ এই শিশুদের রক্ত পরীক্ষায় হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রক্তশূন্যতাও প্রবল। 

“রক্তশূন্যতা, অপুষ্টি ও পটাশিয়ামের ঘাটতি আমরা পেয়েছি। সব দেখে প্রাথমিকভাবে ধরে নিচ্ছি এটা দীর্ঘদিনের অপুষ্টির ফল। এ কারণেই এক ধরনের সংক্রমণ ঘটেছে।”

আক্রান্ত শিশুদের রক্ত ছাড়াও লালা ও মূ্ত্রের নমুনা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “লোকালি কিছু পরীক্ষা আমরা করব। আর উচ্চতর পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় কিছু নমুনা আমরা নেব। সার্বিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে, সমস্ত তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দুই দিনের মধ্যে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব এটা আসলে কী ধরনের রোগ।”

সীতাকুণ্ডের বারআউলিয়া সোনাইছড়ির যে পাড়ায় শিশুদের মধ্যে এই অসুস্থতা দেখা দিয়েছে, সেখানে পাহাড়িরাই বসবাস করেন। তাদের অধিকাংশের জীবন চলে জুমচাষ ও দৈনিক শ্রমের ভিত্তিতে।

ত্রিপুরা পাড়ার শতাধিক শিশুর মধ্যে স্কুলে যায় হাতে গোণা কয়েকজন। তাদের জীবন মূলত পাহাড়ে নিজেদের আবাসস্থলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

গত মাসের শেষ দিক থেকে ওই এলাকার শিশুদের মধ্যে জ্বর, ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট ও  খিঁচুনির মত উপসর্গ দেখা দেওয়া শুরু করে। কিন্তু অভিভাবকরা হাসপাতালে না যাওয়ায় চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি জানতে পারে বুধবার পর্যন্ত নয় শিশুর মৃত্যুর পর।

খবর পেয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি দল বুধবার সেখানে গিয়ে ৪৬টি অসুস্থ শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। বৃহস্পতিবার আরও ছয় শিশুকে হাসপাতালে পাঠায় ত্রিপুরা পাড়ায় ক্যাম্প করা স্বাস্থ্যকর্মীরা।

এই ৫২ জনের মধ্যে ১৩টি শিশু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বাকিরা ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে (বিআইটিআইডি) চিকিৎসাধীন। অধিকাংশের বয়স দুই থেকে দশ বছরের মধ্যে।

ডা. ফারুক জানান, হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের মধ্যে একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। বাকিদের অবস্থা উন্নতির দিকে।

“আক্রান্তদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হচ্ছে। ওই এলাকার বাচ্চাদের পুষ্টিহীনতা দূর করতে কর্মসূচি নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে।”

বুধবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে রাত ৩টা থেকে ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতে কাজ শুরু করে আইইডিসিআরের পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দলটি। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার সকালে তারা চট্টগ্রাম মেডিকেলে যান। সোনাইছড়ির ত্রিপুরা পাড়াতেও তাদের যাওয়ার কথা রয়েছে।

হাসপাতালে শিশুদের সঙ্গে থাকা অভিভাবক ও ত্রিপুরা পাড়া ঘুরে আসা চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ২০ দিন আগে শিশুরা অসুস্থ হওয়া শুরু করলেও পাড়ার বৈদ্যের ঝাড়ফুঁক ও তাবিজকবজেই তারা ‘চিকিৎসা’ চালাচ্ছিলেন।

স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক এ এম মুজিবুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যখন (ত্রিপুরা পাড়ায়) গেলাম তখন তারা আমাদের কাছ থেকে মৃতদের ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আক্রান্তদের ঘরের ভেতর রেখে নানা ধরনের তাবিজকবজ আর বৈদ্য দিয়ে জিন ভূত তাড়ানোর মাধ্যমে তারা বাচ্চাদের সুস্থ করার চেষ্টায় ছিল।”

পরে তাদের পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝিয়ে আক্রান্তদের হাসপাতালে নিতে রাজি করানো হয় বলে জানান তিনি।

ডা. মুজিবুল হক বলেন, প্রথমে জ্বর হওয়ার পর গ্ল্যান্ড ফুলে গিয়ে বমি হচ্ছিল ওই শিশুদের। যারা মারা গেছে, শেষের দিকে তারা প্রচণ্ড নিউমোনিয়ায় ভুগছিল।

শুরুতেই খবর পেলে আর পরিবারগুলো সচেতন থাকলে এভাবে নয়টি শিশুর মৃত্যু হত না বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, “রোগটি কী তা আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলা যাবে। তবে এই শিশুরা সবাই মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। গতকাল হাসপাতালে আনার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এক দিনেই অনেকের চেহারায় প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে।”