নিঃসন্তান শাকিলা-জাকির পেলেন ‘একুশ’কে

ময়লার স্তূপে পাওয়া নবজাতক ‘একুশ’কে চেয়ে আবেদন করেছিলেন ১৬ জন, তাদের মধ্যে আদালতের সায় পেলেন চিকিৎসক জাকিরুল ইসলাম ও শাকিলা আক্তার দম্পতি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2017, 01:25 PM
Updated : 29 March 2017, 03:05 PM

বুধবার রায় জানানোর সময় বিচারক চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও শিশু বিষয়ক আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌসের কণ্ঠও আবেগঘন হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, “প্রত্যেকের আবেদনে মাতৃত্বের জন্য কান্না আমাকেও স্পর্শ করেছে। আমি অসহায় বোধ করছি। একাধিক শিশু থাকলে প্রত্যেককে একটি করে শিশু দিতাম।”

আবেদনকারীর মধ্যে গৃহিনী, শিক্ষিকা, আইনজীবী, পুলিশ সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার নারীরা ছিলেন। তাদের অধিকাংশই নিঃসন্তান, তিন সন্তান হারানো এক দম্পতিও ছিলেন এর মধ্যে।

বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, “শিশুটির ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে ৩ নম্বর আবেদনকারী শাকিলা আক্তারের আবেদন গ্রহণ করলাম।

“তার ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে কোনো সন্তান নেই। আশা করি, তারা শিশুটির ভবিষ্যত জীবন নিরাপদ করবে।”

একুশের জিম্মা পাওয়া শাকিলা আক্তার

এসময় শাকিলা আক্তার কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বামী জাকিরুলকে জড়িয়ে ধরেন।

একুশের জিম্মার বিষয়ে আদালত চারটি শর্ত দিয়েছে। তা হলো- ৫ এপ্রিলের মধ্যে শিশুটির জন্য ১০ লাখ টাকার শিক্ষা বীমা করা, ভবিষ্যতে কখনও বাবা-মা এলে ডিএনএসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে শিশুটিকে ফেরত দেওয়া, জিম্মায় পাওয়ার তিন মাস ও ছয় মাসের সময়ে একবার করে এবং এরপর থেকে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আদালতকে শিশুটির বিষয়ে অবহিত করা এবং শিশুটির স্বার্থের পরিপন্থি কোনো কিছু না করা।

এসময় এক আবেদনকারীর প্রশ্নের জবাবে বিচারক জান্নাতুল বলেন, শিক্ষা বীমার অর্থ শিশুটির নামেই থাকবে। ভবিষ্যতে কেউ বাবা-মা দাবি করলে বা জিম্মায় পাওয়া অভিভাবক এই অর্থ পাবে না।

একুশকে পাওয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠেই শাকিলা বলেন, “নিঃসন্দেহে খুব ভালো লাগছে। শিশুটিকে আমি আমার মতো করে মানুষ করতে চাই। একজন মা যেভাবে সন্তানকে লালন পালন করে ওইভাবেই মানুষ করব।”

চিকিৎসক জাকির বলেন, “দীর্ঘদিন খরার পর যেন বৃষ্টি হয়েছে। আমার অনেক আনন্দ। ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সন্তানকে আলোকিত মানুষ করতে চাই।”

জাকির ও শাকিলা দম্পতি নগরীর চকবাজার ধনির পুল এলাকায় বসবাস করেন।

তাদের আইনজীবী জাহিদ মো. আল ফয়সাল চৌধুরী বলেন, শিক্ষা বীমার কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরই শিশুটিকে জিম্মায় পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে আইনগত প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করবেন তারা।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরীর আকবর শাহ থানার কর্নেল হাট প্রশান্তি আবাসিক এলাকায় একটি ভবনের পিছনে আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় নবজাতকটিকে।

কয়েকজন যুবক শিশুটিকে উদ্ধারের পর পুলিশকে বিষয়টি জানায়। পরে শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। একুশের প্রথম প্রহরের আগে উদ্ধার হওয়ায় আকবর শাহ থানার ওসি মোহাম্মদ আলমগীর শিশুটির নাম দেন ‘একুশ’।

বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক বিভাগে আছে শিশুটি। সেখানে চিকিৎসক, সেবিকা ও অন্য নবজাতকের মায়েরা শিশুটির পরিচর্যা করছেন।

এরপর একুশ’র জিম্মা চেয়ে আদালতে ১৬টি আবেদন জমা পড়ে। এ বিষয়ে ২২ মার্চ ও ২৮ মার্চ আদালতে শুনানি হয়। চারজন অনুপস্থিত থাকায় মোট ১২ জনের আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয় আদালতে।

বুধবার বেলা ১২টায় বিচারক জানান, শিশুটির জিম্মার বিষয়ে আদেশ বেলা ৩টায় দেওয়া হবে।

৩টা ১০ মিনিটের দিকে এজলাসে ওঠেন বিচারক। আবেদনকারীদের বামপাশে দাঁড়াতে বলা হয়। তখন উপস্থিত নয়জন সেখানে গিয়ে দাঁড়ান। 

বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, “আমি কোনো মহামানব নই। বাচ্চা যেহেতু একটি, তাই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারব না। আমারও সীমাবদ্ধতা আছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হত্যা মামলার চেয়েও বেশি সময় লেগেছে।”

যারা আবেদন করেছেন, তাদের আর্থিক সঙ্গতি এবং শিশুটির সামগ্রিক কল্যাণ বিবেচনা করে আদেশ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

“আবেদনকারীদের অনেকে জিম্মায় পেলে শিশুটিকে মূল্যবান অর্থ-সম্পদ দানের অঙ্গীকারও করেছেন। কিন্তু এ অঙ্গীকার শিশুটির ভবিষ্যতের জন্য সমীচীন ও সঙ্গত নয়। এরকম হলে ভবিষ্যতে যে কেউ নিজেকে শিশুটির মা-বাবা হিসেবে দাবি করতে পারেন,” বলেন জজ জান্নাতুল ফেরদৌস।