৩ সন্তান হারানো দম্পতিও চান ‘একুশ’কে

চট্টগ্রামে ময়লার স্তূপ থেকে উদ্ধার নবজাতকটিকে পেতে ১৬টি আবেদনের শুনানি হয়েছে আদালতে; বুধবার জানা যাবে কারা পাচ্ছে শিশুটিকে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2017, 11:32 AM
Updated : 28 March 2017, 11:32 AM

‘একুশ’ নাম পাওয়া শিশুটিকে পেতে নিঃসন্তান দম্পতিরা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন তিন সন্তান হারানো দম্পতিও।

আবেদনকারীর মধ্যে গৃহিনী, শিক্ষিকা, আইনজীবী, পুলিশ সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার নারীরা ছিলেন।

শিশুটিকে যে যুবকরা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন, তাদের একজনের আপন বোন এবং অন্য একজনের খালাত ভাইও ছিল আবেদনকারীর তালিকায়।

মঙ্গলবার চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও শিশু বিষয়ক আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌসের আদালতে তাদের আবেদনগুলোর শুনানির দিন নির্ধারিত ছিল।

দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত বুধবার একুশের জিম্মা নির্ধারণ বিষয়ে আদেশ দেওয়ার দিন নির্ধারণ করেছেন।

এর আগে গত ২২ মার্চ এ বিষয়ে আংশিক শুনানি হয়েছিল। সেদিন আদালতের দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করে দম্পতিরা স্ত্রীর নামে নতুন আবেদন জমা দেন। মঙ্গলবার আবার নতুন করে শুনানি শুরু হয়।

আবেদনকারী শাকিলা আক্তার ও চিকিৎসক জাকির হোসেনের আইনজীবী জানান, ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তান না থাকায় তারা একুশকে জিম্মায় পেতে চান।

আইনজীবী চুমকি চৌধুরী ও মো. হানিফ দম্পত্তির পক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়ে আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী বলেন, “আবেদনকারী একজন আইনজীবী। ওই শিশুর মা সন্তান ফেরত চাইলে সহজেই তা সম্ভব হবে।”

চুমকির পক্ষে আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, “উনার এক কন্যা সন্তান আছে। সন্তান প্রতিপালনের অভিজ্ঞতা উনার আছে।”

উদ্ধার নবজাতকটি, যে নাম পেয়েছে একুশ

এসময় বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, “প্রথম যখন কেউ মা হয় তখন কারোরই অভিজ্ঞতা থাকে না। আপনার এক মেয়ে আছে। তাকে এমনভাবে মানুষ করুন যেন অনেক বড় হতে পারে।”

এরপর আরও চার আবেদনকারীর আবেদনের বিষয়ে শুনানি হয়।

তারপর পুলিশ সদস্য এসআই পারভীন এর পক্ষে শুনানিতে আইনজীবী বলেন, ১০ বছরের সংসার জীবনে সন্তান না থাকায় তিনি একুশকে জিম্মায় চান।

এরপর গৃহিনী জান্নাতুল ফেরদৌস এবং আইনজীবী মো. মোজাম্মেল হোসেনের আবেদনের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়।

তাদের পক্ষে আইনজীবী মোস্তফা শরিফী আদালতকে জানান, এই দম্পত্তির জন্ম নেওয়া তিনটি শিশুই মারা গেছে।

২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল জন্মের দিনই জান্নাতুলের প্রথম সন্তানটি মারা যায়। এরপর ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া শিশুটি পরের বছর ৯ মার্চ মারা যায়। সবশেষ ২০১৬ সালের ২৫ জুলাই জন্ম নেওয়া শিশুটি গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর মারা যায়।

“দুই বার সিজারিয়ান অপারেশন হওয়ায় আর সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করলে আমার মক্কেলের প্রাণ শঙ্কা হতে পারে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন,” বলেন জান্নাতুলের আইনজীবী।

এই শুনানি চলাকালে বিচারককেও বিমর্ষ দেখা যায়। এজলাসে জড়ো হওয়া অর্ধ শতাধিক আইনজীবীও নীরবে শুনানি শুনতে থাকেন।

মোস্তফা শরিফী বলেন, “তৃতীয় সন্তানের জন্মের পর আমার মক্কেল সন্তানের জন্য একটি শিক্ষা বীমা করেছিলেন। ওই সন্তানের মৃত্যুর পরও তিনি সেই বীমা চালিয়ে যাচ্ছেন। একটি সন্তানের জন্য তীব্র আকাঙ্খায় তিনি অপেক্ষা করছেন।”

এরপর আরও একটি আবেদনের শুনানি শেষে আসেন গুলশান আক্তার ও মকবুল হোসেন দম্পত্তি।

মকবুল হোসেন বলেন, “একুশকে উদ্ধারের পরপর রক্তমাখা অবস্থায় এনে আমার শ্যালক আমাদের হাতে দেয়। তাকে আদরযত্ন করে তার প্রতি আমাদের মায়া জন্মে গেছে।”

শুনানির শেষ দিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম এ ফয়েজ আদালতে বলেন, যিনি সন্তানের মা হতে পারবেন না বা যার পক্ষে সন্তান নেওয়া সম্ভব না- এমন কাউকে এ সন্তান দেওয়া হোক।

শুনানি শেষে বিচারক বলেন, শিশুটির জিম্মা স্থায়ীভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু জিম্মা দিতে পারি।

“পরে কখনও শিশুটির বাবা-মা যদি আসে। তখন তারা যদি সম্মতি দেয় তখন জিম্মায় পাওয়া অভিভাবক শিশুটিকে সর্বোচ্চ ১৮ বছর পর্যন্ত জিম্মায় রাখতে পারবেন।”

শুনানি চলাকালে আবেদনকারীদের জমা দেওয়া বেশি সংখ্যক কাগজপত্র দেখে বিচারক হেসে বলেন, এত কাগজ লাগবে না। এত কাগজ রাখতে তো আরেকটা রেকর্ড রুম লাগবে। শুধু মূল কাগজগুলো চাই। 

শুনানি শেষে আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন শিশুকে জিম্মায় চেয়ে এত আবেদন প্রমাণ করে মানবিক দিক থেকে আমরা পিছিয়ে নেই। মানবিকতার দিক থেকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।”

“আগামীকালই জানা যাবে একুশকে জিম্মায় পাচ্ছেন কারা,” বলেন তিনি।

একুশকে জিম্মায় পেতে আবেদন করেন- গৃহিনী জেসমিন আক্তার, শিক্ষিকা ‍লুবনা ইয়াসমিন, শাকিলা আক্তার, আইনজীবী চুমকি চৌধুরী, শাহিদা জাহান, শাহানা আক্তার, ইয়াসমিন আক্তার, শবনম শারমিন, পুলিশের এসআই পারভিন, গৃহিনী জান্নাতুল ফেরদৌস, ইসরাত জাহান, গুলশান আক্তার, নাসিমা বেগম, রুকসানা আক্তার, মনসুর আলম চৌধুরী ও এসআই মো. সাইফুল্লাহ।

শেষ চার জন অনুপস্থিত থাকায় মোট ১২ জনের আবেদনের বিষয়ে শুনানি হয়।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরীর আকবর শাহ থানার কর্নেল হাট প্রশান্তি আবাসিক এলাকায় একটি ভবনের পিছনে আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় নবজাতকটিকে।

কয়েকজন যুবক শিশুটিকে উদ্ধারের পর পুলিশকে বিষয়টি জানায়। পরে শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আকবর শাহ থানার ওসি মোহাম্মদ আলমগীর শিশুটির নামকরণ করেন ‘একুশ’।

বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে শিশুটি। সেখানে চিকিৎসক, সেবিকা ও অন্য নবজাতকের মায়েরা শিশুটির পরিচর্যা করছেন।