‘বিয়ে, আত্মীয়তা, নতুন জঙ্গি ইউনিট’

সীতাকুণ্ডের প্রেমতলায় ‘ছায়ানীড়ে’ আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত কামাল উদ্দিনের বাবা তার ছেলের এ পরিণতির জন্য দুষছেন পুত্রবধূ জোবায়দা ইয়াসমিন ও তার ভাই জহিরুল হক জসিমকে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোমোস্তফা ইউসুফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2017, 04:27 PM
Updated : 21 March 2017, 05:29 AM

জোবায়দাও গত ১৬ মার্চ ওই বাড়িতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে স্বামীর সঙ্গে নিহত হন। আর তার ভাই জসিম পাশের নামার বাজার ওয়ার্ডের আমিরাবাদ থেকে স্ত্রী আর্জিনাসহ গ্রেপ্তার হন আগের দিন দুপুরে।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ জানান, জসিমদের আরেক কিশোরী বোনের সঙ্গে কুমিল্লায় গ্রেপ্তার জঙ্গি মাহমুদুল হাসানের বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের।

“কামাল ও জসিম শুরুতে বন্ধু ছিল। পরে জসিমের বোনকে কামাল বিয়ে করলে তাদের মধ্যে আত্মীয়তা হয়। জসিমের আরেক বোনকে হাসানের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা প্রমাণ করে, নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক করে তারা ছোট ছোট ইউনিট গড়ে তুলছিল।”

কামালের বাবা মোজাফফর আহমদ এবং জোবাইদার বাবা নুরুল আলম ও ভাই জিয়াবুল হক সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসে লাশ শনাক্ত করেন। দুই পরিবারেরই বাড়ি বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারি ইউনিয়নে।

কামালের বাবা মোজাফফর আহমদ, জোবাইদার ভাই জিয়াবুল হক ও তাদের বাবা নুরুল আলম

প্রায় ৭০ বছর বয়সী মোজাফফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছেলে যে এত বড় ঘটনা ঘটাবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। এলাকার মানুষের মুখেও এরপর শুনেছি। আজ এখানে এসে দেখলাম এ আমারই সন্তান। তার দিকে আমি ফিরেও চাইব না। আমি লাশ নেব না।”

তার ভাষ্য, জসিম ‘এক প্রকার  যেচে এসে’ তার বোনকে কামালের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের পর থেকেই ‘পাল্টে যেতে থাকে’ কামাল। স্ত্রীর চিকিৎসার কথা বলে নয় মাস আগে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

“জসিমের বোনকে যদি বিয়ে না করত, তাহলে হয়ত কামালের এ পরিণতি হত না,” বলেন তার বাবা। 

মোজাফফর জানান, তার ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে কামাল মেজো। স্থানীয় একটি কওমী মাদ্রাসায় জসিমের সঙ্গে নাহুম (চতুর্থ শ্রেণি) পর্যন্ত লেখাপড়া করেন তিনি।

কামাল গতবছর রোজার সময় জোবায়দাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়লেও জসিম ও তার স্ত্রী আর্জিনা লাপাত্তা হন তিন মাস আগে। তার আগ পর্যন্ত কামালের সঙ্গে জসিমের নিয়মিত যোগাযোগ হত বলে জানান মোজাফফর।

“আমি জসিমকে বলতাম চিকিৎসা করাতে এতদিন লাগবে কেন? ও (কামাল) আমার সাথে যোগাযোগ করে না কেন? তখন জহির বলত ওরা শহরে কাজ পেয়েছে, ভালো আছে। সময় হলে চলে আসবে।”

গত ১৬ মার্চ আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হন কামাল ও জোবায়দা

বাড়ি ছাড়ার আগে কামাল বাইশারিতে পানের বরজ ও চাষাবাদ করতেন। পান বিক্রি থেকে প্রতি সপ্তাহে তার আয় ছিল কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। তারপরও কেন তিনি শহরে কাজ করতে যেতে পারেন, সে হিসাব মেলাতে পারছিলেন না বলে জানান তার বাবা।

তিনি বলেন, কামালের পানের বরজে নানা ধরনের লোক কাজ করতে যেত। কামাল স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার পর পানের বরজের দেখভাল করতেন জসিম। বরজের লাভের হিসাব জানতে চাইলে জসিম ‘শ্রমিকদের পেছনে টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার’ মত বিভিন্ন যুক্তি দেখাতেন।

“আমার সোনার সংসার ছিল। এ ছেলে সব শেষ করে দিয়ে গেছে। পরিবারের সবাই এখন মুষড়ে পড়েছে। এ ছেলের লাশ আর দরকার নাই।”

অন্যদিকে জসিম বিয়ের পর থেকেই পাশের গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন এবং সেখানেই ক্ষেতখামার করতেন বলে জানান তার বাবা নুরুল আলম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তিন মাস আগে জসিম এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসে। আমাদের সঙ্গে আগেও খুব বেশি যোগাযোগ হত না। শহরে চলে আসার পর আর দেখা হয়নি।”

নুরুল আলম জানান, তাদের পরিবার কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর শাপলাপুর থেকে ১৯৮৪ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারিতে আসে। তার আট ছেলে চার মেয়ের মধ্যে জসিম দ্বিতীয়, আর কামালের স্ত্রী জোবাইদা মেয়েদের মধ্যে তৃতীয়।

গ্রেপ্তারের পর জসিম ও আর্জিনা

জোবাইদার বাবাও চট্টগ্রামে মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গি সন্তানের লাশ তিনি চান না। মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন জোবাইদাদের বড় ভাই জিয়াবুল।

সাংবাদিকদের জিয়াবুল বলেন, তাদের আরেক বোন ১৭ বছর বয়সী মঞ্জি আরাও ছয় মাস ধরে ‘নিখোঁজ’। পরিবারের কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাচ্চা দেখাশোনার কথা বলে কামাল উদ্দিন তার শ্যালিকা মঞ্জি আরাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যান। কুমিল্লায় ধরা পড়া জঙ্গি মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে মঞ্জি আরার বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।”

গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশের দিকে বোমা ছোড়ার পর ধরা পড়েন হাসানসহ দুই জঙ্গি। তাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাতেই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

তার এক সপ্তাহের মাথায় সীতাকুণ্ডর দুই বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে। এরা সবাই নব্য জেএমবির সদস্য বলে পুলিশের ভাষ্য। 

হাসানের সঙ্গে মঞ্জি আরার বিয়ে হয়েছিল কি না, ওই কিশোরী এখন কোথায়- এসব প্রশ্নের নিশ্চিত কোনো উত্তর পুলিশ এখনও পায়নি।