জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গি দম্পতিকে ধরলেন তারা

সীতাকুণ্ডের সাধন কুঠিরে জঙ্গি দম্পতিকে ধরে ফেলতে গিয়ে কীভাবে নিজের জীব্নকে ঝুঁকিতে ফেলেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন বাড়িওয়ালা সুভাষ চন্দ্র দাশ ও তার স্ত্রী ছবি রানি দাশ।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2017, 06:43 PM
Updated : 16 March 2017, 07:02 PM

বুধবার পৌর এলাকার নামার বাজারে ওই বাড়ি থেকে জসিম ও আর্জিনাকে ধরার পর তাদের দেওয়া তথ্যে পাশের আরেকটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান যায় পুলিশ।

বৃহস্পতিবার সেই ‘ছায়ানীড়ে’ অভিযানে নিহত হন এক শিশুসহ পাঁচজন, যার মধ্যে নব্য জেএমবির দুজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ রয়েছেন বলে পুলিশের দাবি।

যে বাড়ি থেকে পরের আস্তানার সন্ধান মেলে বৃহস্পতিবার দুপুরে সেই সাধন কুঠিরের ছাদে বসে আগের দিনের ঘটনার বর্ণনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেন বাড়ির মালিক সুভাষ ও তার স্ত্রী ছবি।

দোতলা এই বাড়ির নিচ তলার একটি ফ্ল্যাট মার্চ মাসেই ভাড়া নিয়েছিলেন জসিম, তবে ভাড়া নেওয়ার সময় তার দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রটি ভুয়া বলে সন্দেহ হয় বাড়িওয়ালা সুভাষের।

তিনি জানান, মঙ্গলবার রাতে নিচতলায় ভাড়া নেয়া ওই বাসা থেকে দুজন একটি ল্যাপটপ ও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে সরে পড়ে।তাদের একজনের বয়স ১৫। আর অন্য জনের বয়স ২৫-২৬ বছর।

সুভাষ বলেন, যুবকটির মুখে দাড়ি ছিল। কিশোরটি ফর্সা ও সুন্দর দেখতে। সে সবসময় হেসে কথা বলত।

সন্দেহজনক আচরণ ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় বুধবার দুপুরে ওই পরিবারকে ঘর ছেড়ে দিতে বলতে নিচতলার বাসাটিতে যান সুভাষ। তখন তার সঙ্গে ছিলেন ভাই সুরেশ, স্ত্রী ছবি, বোন মুক্তি ও বন্ধু সাগর।

সুভাষ বলেন, “ঘরের দরজা নক করি। ২-৩ মিনিট পর তারা দরজা খোলে। এসময় আমার স্ত্রী সাগরকে দেখিয়ে বলে, ও প্রশাসনের লোক। এ কথা বলার পরই জসিম ভেতরের বেডরুমে ঢুকে খিল লাগিয়ে দেয়। সেখানে ওই মহিলাও (আর্জিনা) ছিল।”

কয়েক মিনিট সুভাষ শোবার ঘরের দরজা ধাক্কা দেওয়ার পর জসিম ও আর্জিনা সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

সুভাষ বলেন, “তখন বললাম তোমার ভুয়া আইডি কার্ড দিয়ে প্রতারণা করেছো। এখনই বেরিয়ে যাও। তখন জসিম বলে- ‘সমস্যা নাই, চলে যাব’। আমি বলি, এখনই বের হও।

“এরপর জসিম বিরাট এক ব্যাগ টেনে নিয়ে সেখানে হাত ঢোকায় আর বের করে। আমি ওই ব্যাগ ধরে টান দিই। সাথে সাথে ওই মহিলা (আর্জিনা) সাগরের শার্টের কলার ধরে ফেলে। তখন আমার স্ত্রী আর্জিনার দু’হাত ধরে ফেলে।”

এরপর সুভাষ সেই বড় আকারের ব্যাগটি খুলে এর ভেতরে একটি বিস্কুটের প্যাকেট, কয়েকটি কাপড়ের প্যাকেট এবং এক জোড়া বুট জুতো দেখতে পান। একটি জুতার ভেতরে ছিল পিস্তল।

সুভাষ বলেন, “পিস্তল দেখার সাথে সাথে আমি সেটি হাতে নিয়ে ফেলি। তারপর আমি আর সাগর মিলে জসিমকে ধরে ফেলি। আমার স্ত্রী ওই মহিলাকে ধরে রাখে।

“ওই মহিলা (আর্জিনা) বার বার তার কোমরে হাত নিতে চেয়েছিল। তখন এক হাতে জসিমকে এবং অন্য হাতে মহিলাকে ধরে রাখি। আমার স্ত্রী কোনোভাবেই তাকে কোমরে হাত নিতে দেয়নি।”

ছবি রানি বলেন, “এক পর্যায়ে ওই মহিলা বলে- ‘আমাকে ছাড়, না হলে তুইসহ ফুটবি, ছাড়, আমি কিন্তু পরে আবার আসব’। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের কক্ষ থেকে বের হতে দিইনি আমরা।”

সুভাষ বলেন, “এসময় আমার ভাই ও বোন বেরিয়ে ডাকাত-ডাকাত বলে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু আশেপাশের কেউ এগিয়ে আসেনি। প্রথমে আমার বোন মুক্তি এবং পরে ভাই সুরেশ থানায় ফোন করে।”

ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় নেয় বলে জানান সুভাষ।

এসময়ের পুরোটাই ওই নারী নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে সুভাষ, সাগর ও ছবি রানি মিলে দুই জঙ্গিকে আটকে রাখেন।

এই দুই জঙ্গির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘ছায়ানীড়’ এ অভিযানের সময় সেখানে থাকা চার জঙ্গি সদস্য ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’র বিস্ফোরণ ঘটায় বলে পুলিশ জানায়।বৃহস্পতিবার সেখানে তল্লাশি চালিয়ে ১০টি বোমা উদ্ধার করা হয়, সঙ্গে তিনটি ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’।

নামার বাজারে গ্রেপ্তার জঙ্গি আর্জিনার কোমরেও ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ বাঁধা ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।

সুভাষ বলেন, “ওই মহিলা কোমরের কাছে হাত নিতে চাওয়ায় আমার সন্দেহ হয়েছিল। সম্ভবত সেখানে কোনোকিছু ছিল। যাতে টান দিতে পারলে ওই বোমা বিস্ফোরণ ঘটত। তখন কী হত, তা ভাবতেই পারছি না।”

সুভাষ ও তার স্ত্রীর ধারণা, তাদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার দুজনই শিক্ষিত। ওই বাসায় একটি ইংরেজি কোরআনসহ কয়েকটি কোরআন দেখেছিলেন সুভাষ। এ ছাড়া তাদের ঘরে একটি খাতাও দেখতে পান তিনি, যাতে বিভিন্ন করণীয় লেখা ছিল।

তিনি বলেন, “খাতার শুরুতে লেখা ছিল- কাজের সময় দরজা নক করলে খুলতে সাবধান। এছাড়া খাতাটির ভেতরে ইংরেজিতে আরও বেশ কিছু লেখা দেখেছি।”