‘অপারেশন জ্যাকপটের’ প্রস্ততি যেভাবে

মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে এসে শ্বাসরুদ্ধকর নৌ কমান্ডো অপারেশন ‘অপারেশন জ্যাকপটের’ গল্প আর সেই অভিযানে অংশ নেওয়া নৌ কমান্ডোদের প্রস্তুতির বর্ণনা শুনে মুগ্ধ হয়েছেন চট্টগ্রামের শতাধিক তরুণ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2017, 05:06 PM
Updated : 3 March 2017, 05:21 PM

শুক্রবার নগরীর ফুলকি মিলনায়তনে ‘যোদ্ধার মুখে যুদ্ধের কথা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে অপারেশন জ্যাকপটের প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নের বর্ণনা দেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডের ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম জিলানী চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম এর ট্রাস্টি মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম রইসুল হক বাহার।

মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস হিসেবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ডিবেট।

অনুষ্ঠানে অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম কুশীলব এ এইচ এম জিলানী বলেন, “বীরত্বপূর্ণ এ অপারেশন এতটাই সফল হয়েছিল যে, আমেরিকা ও ভারত তাদের নৌ বাহিনীর প্রশিক্ষণে এ অপারেশনটাকে উদাহরণ হিসেবে হাজির করে।

তিনি ‍আক্ষেপ করে বলেন, “অথচ যুদ্ধ করে যাদেরকে আমরা একটা দেশ দিলাম, তাদেরকে এ ইতিহাস জানানো হয়নি। তারা জানে না, তাদের পূর্বসুরীদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস।”

এ অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে কিভাবে বাংলাদেশের কুমিল্লা সীমান্ত হয়ে নানা বাঁধা পেরিয়ে ভারতে পৌঁছান- শতাধিক তরুণের সামনে তার বর্ণনা তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা জিলানী।

তিনি বলেন, “আমি তখন নিজামপুর কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। ২৫ মার্চে হানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউন শুরু হয়ে গেছে। এপ্রিলে আমরা ভারতের সীমান্ত পৌঁছে বিএসএফের হাতে আটক হই।

“পরে বিএসএফর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদেরকে আগরতলায় একটা স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠালে, আমরা বৃহত্তর প্রশিক্ষণের জন্য খবর নিতে থাকি নানান জায়গায়।

অপারেশন জ্যাকপটের এই যোদ্ধা বলেন, “নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে আগরতলা থেকে পশ্চিমবঙ্গের পলাশী প্রান্তরের ভাগিরথীর তীরে আমাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়। সেখানে জানানো হল, আমাদেরকে দিয়ে আত্মঘাতি দল তৈরি করা হবে।”

সেখানে পুরো ভাগিরথী নদী স্বল্প সময়ে সাঁতার কেটে পার হওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশিক্ষণের যোগ্য হিসেবে বেশ কয়েজনের সঙ্গে তিনিও উত্তীর্ণ হন জানিয়ে জিলানী বলেন, “প্রায় তিন মাস ধরে চলে আমাদের কঠিন অনুশীলন।

“শরীরের সাথে পাঁচ কেজি ওজনের ইট বেঁধে নদীতে ২০ কিলোমিটার সাঁতার কাটানো হত। এমনও হয়েছে, রাত ১২টায় ঘুম থেকে তুলে ভাগিরথীতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের। সাঁতার কেটে আসতে আসতে দেখা গেল ভোর হয়ে গেছে।”

এভাবে পানির নিচে অন্তত আট থেকে ১০ মিনিট থাকার কৌশল নৌ কমান্ডোরা রপ্ত করেছিলেন বলে জানান তিনি। 

এভাবে প্রায় দিনের ১৮ ঘণ্টা প্রশিক্ষণে যেত জানিয়ে এই স্বাধীনতা সংগ্রামী বলেন, “সাঁতার কেটে আসার পর শুরু হত আমাদের ডেমোলিশন ও কমব্যাট ট্রেনিং। কিভাবে খালি হাতে শত্রুকে পরাস্ত করতে হয়। কিভাবে ভবন, সেতু, বৈদ্যুতিক স্থাপনা ধ্বংস করতে এ জন্য শেখাতে হত ডেমোলিশন।”

এভাবে ১৮০ জন নৌ কমান্ডোকে চট্টগ্রাম, মংলা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর নৌ চ্যানেলে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করা হয় বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডো দলের এই সদস্য।

জিলানী বলেন, “আমাদের যারা প্রশিক্ষক ছিল, তারা কখনো ভাবেনি আমরা বেঁচে ফিরতে পারব। যেদিন ক্যাম্প থেকে বিদায় দেওয়া হচ্ছিল, সেদিন তারা ভেবেছিল এটাই শেষ বিদায়।”

১৯৭১ সালের ১০ অগাস্ট দেশে ফিরে অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে নৌ কমান্ডো দল। অবশেষে ১৫ অগাস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ চ্যানেলে সফল অপারেশনে পাকিস্তানি বেশ কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম রইসুল হক বাহার বলেন, “পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রথম জনতার প্রতিরোধ হয় ২৪ মার্চ। এ দিন চট্টগ্রাম বন্দরের তিন নম্বর জেটিতে পাকিস্তানি জাহাজ এমভি সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস আটকে দেয় জনতা।”

সেদিন হানাদার বাহিনীর গুলিতে ২৩ জন শহীদ হন বলে জানান তিনি।

“ওয়ার ইজ দ্যা কনটিনিউয়েশন অব পলিটিক্স। সে হিসেবে আমাদের যুদ্ধ এখনো চলছে,” মন্তব্য করে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে এ ধরনের প্রয়াস অব্যাহত রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে চিটাগাং ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ডিবেটের সাবেক সভাপতি প্রবীর বড়ুয়া চৌধুরী বক্তব্য রাখেন।

উপস্থিত ছিলেন চিটাগাং ইউনিভার্সিটি স্কল অব ডিবেটের সভাপতি মাহমুদুল হাসান রনি ও সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদিন।