বুধবার বিকালে এদের ধরার আগেই বিমানে চড়ে বসায় ২১ জনকে নামিয়ে আনা যায়নি বলে র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তারা বলছেন, দুটি বিমানের প্রতিটিতে ৭০ জন করে মোট ১৪০ জনকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পাচারের উদ্যোগ নিয়েছিল পাচারকারী চক্র। কারও কারও সঙ্গে কথা হয়েছিল ইতালি পৌঁছে দেওয়ার।
বৃহস্পতিবার বিকালে পতেঙ্গায় র্যাব-৭ এর সদরদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন বলেন, আগাম টাকা ছাড়াই দরিদ্রদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার ফাঁদ পেতেছিল চক্রটি।
“যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে শুধু একজন অগ্রিম এক লাখ টাকা ও অন্য একজন ৫০ হাজার টাকা দেয়। অন্যদের লিবিয়া পৌঁছানোর পর টাকা পরিশোধের কথা ছিল।”
লিবিয়া পৌঁছে গেলে সেখান থেকে কয়েকজন দালালদের মাধ্যমে এবং কয়েকজনের নিজ উদ্যোগে ইতালি যেতে চেয়েছিল বলে জানান মিফতাহ উদ্দিন।
তিনি বলেন, এদের লিবিয়া পৌঁছানোর পরই শুরু হয় টাকার জন্য নির্যাতন। ফোন করে তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা চাওয়া হয়।
“টাকা পরিশোধের পর আর পাচার হওয়াদের ইতালি নেওয়া হয় না। তাদের লিবিয়ার কোনো মরুভূমিতে ফেলে চলে যায় পাচারকারীরা। এরকম অনেককে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস ইতোপূর্বে উদ্ধার করেছে।”
ঢাকা-চট্টগ্রাম-দুবাই-তুরস্ক-লিবিয়া-ইতালি
উদ্ধার হওয়াদের কাছ থেকে লিবিয়া যাওয়ার বিমানের টিকেট পাওয়া গেছে বলে র্যাব কর্মকর্তা মিফতাহ উদ্দিন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, বিমানের টিকেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এদের যাতায়াতের রুট হলো চট্টগ্রাম-দুবাই-তুরস্ক (ইস্তাম্বুল/আঙ্কারা)- লিবিয়া (ত্রিপোলি)।
এদের কেউ ঢাকা হয়ে আবার কেউ সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছান মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার ভোরে।
মিফতাহ উদ্দিন বলেন, দুবাই এয়ারপোর্টে এদের ‘ডিউটি ফ্রি’ শপে ঘোরাফেরা করারর কথা। বিমানবন্দর থেকে বের হতে তাদের নিষেধ করা হয়।
“সেখানে তাদের চট্টগ্রাম-দুবাই বিমানের টিকেট এবং দুবাইয়ের ভুয়া ভিসা ছিঁড়ে ফেলতে বলা হয়। সেখান থেকে আরেকটি চক্র তাদের তুরস্ক হয়ে লিবিয়া পাঠায়। তুরস্কেও তারা বিমানবন্দর থেকে বের হয় না।”
এভাবে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর সাদিক ও মোজাম্মেল নামের দুই দালাল বিমানবন্দর থেকে তাদের দেশটির বিভিন্ন হোটেলে আটকে ফেলে বলে তথ্য পেয়েছে র্যাব।
উদ্ধার হওয়া একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দালাল বলেছিল, বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা ২০ মিনিটে দুবাই থেকে আমাদের তুরস্কের ফ্লাইট ছাড়বে। ওই পর্যন্ত যেন আমরা বিমানবন্দরের ভেতরেই থাকি।”
ভ্রমণ ভিসায় যাত্রা
উদ্ধারদের ১৯ জনের ভিসা ইস্যু হয়েছে একইদিন, গত ৫ অক্টোবর। এসব ভিসার মেয়াদ ৩০দিন। এগুলো সবই ভ্রমণ ভিসা।
এছাড়া সাতজনের ভিসা একদিনের। পাঁচজনের ভিসা পাঁচদিন মেয়াদি এবং চারজনের কাছে ছিল ভিসার ফটোকপি। গত ১০ জুন মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া ভিসাও ছিল দুজনের কাছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানার আমির হোসেনের চার ছেলে মেয়ের মধ্যে সবার বড় সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা সাইফুল ইসলাম।
সাইফুল বলেন, “পাশের গ্রামের এক বড় ভাই গেছে। তার সাথে আমার যোগাযোগও হয়েছে। তিনি লিবিয়া গেছেন। আমার পাসপোর্টে ৩০ দিনের ভ্রমণ ভিসা ছিল।”
সিলেটের বিশ্বনাথের ফাহিম আহমদের সঙ্গে কথা হয়েছিল ইতালি পৌঁছে দেওয়ার। এজন্য দালালদের সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকায় রফা হয়েছিল তার।
ওই জেলারই গোলাপগঞ্জের মমিন আহমেদের গন্তব্যও ইউরোপের দেশটি। পাচারকারীদের সঙ্গে আট লাখের চুক্তি করা এই যুবক এরইমধ্যে শরীফ নামে একজনকে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জের ছাতক থানার বাগইন গ্রামের সমরু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ লিটন এলাকায় আইপিএস বিক্রি করতেন। ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়ে দোকান বিক্রি করেছেন। জীবিকার সন্ধানে চার লাখ ২০ হাজার টাকায় লিবিয়া যেতে পূর্ব পরিচিত সুমন ও সাজীবের প্রস্তাবে রাজি হন তিনি।
লিবিয়া গিয়ে কী কাজ করবেন তা জানতেন না লিটন। তিনি বলেন, মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করা যাবে বলেছিল।
“সিলেট থেকে ঢাকায় এসে পাঁচদিন ফকিরাপুলের ড্রিমল্যান্ড হোটেলে ছিলাম। গাড়ি ভাড়া ও থাকা খাওয়ায় আমার ৮-১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।”
লিটনের কাছে একটি লাইফ জ্যাকেটও পাওয়া গেছে, যা থেকে র্যাব কর্মকর্তাদের ধারণা ইতালি যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই এ পথে হেঁটেছিলেন তিনি।
ইউরোপে অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের অন্যতম রুট হয়ে উঠেছে লিবিয়া থেকে বড় নৌযানে ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির বিভিন্ন দ্বীপে পৌঁছানো। এভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবে অনেকের মৃত্যুর খবর আসছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ধরাও পড়ছেন অনেকে।
৩০ দালালের সঙ্গে দুই ট্রাভেল এজেন্সি
উদ্ধারদের দেওয়া তথ্য মতে এই পাচার চক্রের ৩০ জনকে শনাক্ত করেছে র্যাব।
এরা ঢাকা, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের বাসিন্দা। তাদের সঙ্গে সিলেটের দুই ট্রাভেল এজেন্সি পূর্ব জিন্দাবাজার গ্যালারি মার্কেটের ‘আল মামুন ট্রাভেলস’ এবং ‘শামীম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’র সিলেট শাখার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
র্যাব-৭ অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দিন বলেন, এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে সাদিক ও মোজাম্মেল লিবিয়ায় থাকে।
দালালদের ধরতে দেশের সব র্যাব কার্যালয়ে বার্তা পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যাকে যেখানে পাবে গ্রেপ্তার করা হবে। তারা যত ক্ষমতাবানই হোক আইনের আওতায় আনা হবে।”
এই চক্রের সদস্যরা হলো- সিলেটের মো. লিলু, মতিউর রহমান, সাইদুর রহমান, তফুর আলী, মো. ইউছুফ, আজিজুল হক শাহীন, মো. শাজিন, নাসির, মো. আজাদ, রুমেন, শাহীন, মো. কামাল, মো. মামুন, আদনান আনসারী (শামীম ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস), মো. ফারুক, বতুল মেম্বার, কাদের, শরীয়তপুরের মো. আলমগীর, তুহিন, খোকা ও দ্বীন ইসলাম, ঢাকার রাজীব, এসডি রহমান, মো. হারুণ ও মো. স্বপন, মাদারীপুরের মো. সিরাজ ওরফে রানা ও আল আমিন মাতব্বর এবং বরিশালের কুদ্দুস সরদার।