‘কথা শুনছ না কেন, বলেই চড় মারেন এমপি মোস্তাফিজ’

বাঁশখালীর উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ‘ফর্দ অনুযায়ী’ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ‘নিয়োগ না দেওয়ার’ কারণ জানতে চেয়েই তাকে গালি দেন স্থানীয় সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2016, 03:31 PM
Updated : 1 June 2016, 04:53 PM

তিনি বলছেন, এরপর তাকে চড় মারতে শুরু করেন সাংসদ। এসময় বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কক্ষের দরজা বন্ধ ছিল।

বুধবার বিকালে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এভাবে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাঁশখালীর উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা জাহিদুল বলেন, বেলা ১১টার পর ইউএনও কার্যালয়ে তাকে ডেকে পাঠান সংসদ সদস্য।

বাঁশখালী ইউএনও কার্যালয়ের পাশের ভবনের নিচতলায় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়। সাংসদের ডাক পেয়ে ইউএনও অফিসে যান জাহিদুল ইসলাম।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “আমি ইউএনও সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করে দেখি সেখানে এমপি ছাড়া কেউ নেই।

“তিনি শুরুতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি গালি দিয়ে বলেন, কথা শুনছ না কেন? বলেই তিনি চড় মারতে শুরু করেন।”

জাহিদুল ইসলাম বলেন, “গালি দেওয়ার পর আমি চিৎকার করে বলতে থাকি- আপনি আমাকে গালি দিতে পারেন না। এরপরই বাইরে থেকে দরজা খুলে চার-পাঁচজন ওই কক্ষে ঢুকে পড়ে।

“তারা সবাই মিলে আমাকে চড়-থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি মারতে থাকে। এসময় দরজার বাইরে আরও সন্ত্রাসীরা অবস্থান করছিল।”

জাহিদুল বলেন, “আমাকে মারা হচ্ছে টের পেয়ে ইউএনও অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বাইরের লোকজন ভবনের সামনে ভিড় করে। এক পর্যায়ে লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।”

জাহিদুলের বাম চোখের নিচে, কপালের ডান পাশে এবং পিঠের ডান পাশে মারধরের চিহ্ন আছে।

অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন; গত এপ্রিলে বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার পরও তিনি আলোচনায় এসেছিলেন।

ঘটনার পর একজন অফিস সহকারীকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে যান জাহিদুল। সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে যান আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে।

এর মাঝে ঘটনার বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলমের মাধ্যমে একটি লিখিত অভিযোগ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠান জাহিদুল।

তার অভিযোগ, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানের এপিএস (পলিটিক্যাল) ও উপজেলার ৪ নম্বর বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী তাজুল ইসলাম ১০-১২ দিন আগে একটি তালিকা দেন।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তাজুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো তালিকা আমি দেইনি। ঘটনার সময়ও আমি সেখানে ছিলাম না। সারাদিন প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলাম।”

জাহিদুল ইসলাম বলেন, নয়টি ওয়ার্ডের নয়টি কেন্দ্রের সব প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারের তালিকা দেন তাজুল ইসলাম।

“পাঁচ-ছয়দিন আগে এক রাতে মোবাইলে ফোন করে এমপি ওই তালিকা অনুসরণ না করায় আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। বিষয়টি আমি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে জানাই।”

বিষয়টি শোনার কথা জানিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচন কর্মকর্তা পছন্দ না হলে সাংসদ নিজেই সেটা আমাকে বা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে পারতেন।

“তিনি কমিশনে চিঠি দিয়ে ওই নির্বাচনী কর্মকর্তার বদলি দাবি করতে পারতেন। কিন্তু যা ঘটেছে ... আমরা তো কোনো বর্বর দেশে বাস করি না।”

নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধরের কারণে ৪ জুন অনুষ্ঠেয় বাঁশখালী উপজেলার সব ইউনিয়নের নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে। স্থানীয় সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

এপ্রিলে বাঁশখালীর গণ্ডামারায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার পর আলোচনায় আসেন সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান।

ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের পুরো এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের জানিয়ে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রার্থী কোনোভাবেই এ ধরনের তালিকা দিতে পারেন না। এটা নির্বাচনী আচরণ বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”

‘এরকম দেখেছি জিয়া-এরশাদ আমলে’

বাঁশখালীর ঘটনাকে ‘অস্বাভাবিক’ আখ্যায়িত করে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিচালক আবদুল আলীম  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, এরকম নির্বাচন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের আমলে হয়েছিল।

তার মতে এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সহিংসতার মাত্রা অতীতের সব নির্বাচনকে ছাড়িয়ে গেছে।

“আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নির্বাচনী অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে।”

আবদুল আলীম বলেন, “এরকম নির্বাচন জিয়া ও এরশাদের আমলে দেখেছি। এর দায়িত্ব কমিশনকেই নিতে হবে। নির্বাচনের উপর নির্বাচন কমিশনের যে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই- তা বোঝাই যাচ্ছে।

“গণতন্ত্র বলতে দেশে শুধু নির্বাচনই বাকি ছিল। সেটাও আমরা শেষ করে দিলাম।”

বাঁশখালীর ঘটনায় নির্বাচন কমিশনকে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিচালক আলীম।