ভিটে-পেশা হারানোর শঙ্কা থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নবাসী বলছেন, ভিটে ও পেশা হারানোর শঙ্কা থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন তারা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী বাঁশখালী থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2016, 04:23 PM
Updated : 5 April 2016, 04:57 PM

ওই ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় ৬০০ একর জমি নিয়ে এস আলম গ্রুপ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।

নানা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় সোমবার গ্রামবাসী সমাবেশ করতে গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষের লোকজনের সঙ্গে বাঁধে সংঘর্ষ। তাতে গুলি চালায় পুলিশ, নিহত হয় চারজন।

চারজন নিহত হওয়ার পরদিন মঙ্গলবারও ওই এলাকায় গিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ দেখা যায়।   

‘ভিটা মাটি রক্ষাকারী এলাকাবাসী’ ব্যানারে গ্রামবাসীর ক্ষোভের লক্ষ্য এস আলম গ্রুপ এবং ওই কেন্দ্রের জমি তৈরির কাজ পাওয়া এনএসএন কনসোর্টিয়ামের বিরুদ্ধে।     

তারা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নানাভাবে চাপ দিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে জমি কেনা হচ্ছে অথবা জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

এই লবণ ঘের হারানোর শঙ্কা

১০ হাজার মানুষকে ভিটে-বাড়ি ছাড়া করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভিটারক্ষা কমিটির আহ্বায়ক, গণ্ডামারা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী।

অন্যদিকে এস আলম ও এনএসএন কনসোর্টিয়ামের অভিযোগ, স্থানীয় রাজনীতিক লিয়াকতকে চাঁদা না দেওয়ায় তিনি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের উসকে দিচ্ছেন।

লিয়াকতের ফাঁসির দাবি জানিয়ে ‘উন্নয়নের পক্ষে বাঁশখালীবাসীর’ ব্যানারে মঙ্গলবার বিকালে উপজেলা সদরে মানববন্ধন করেছে ছাত্রলীগ।

চীনা কোম্পানির সহায়তায় ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৬ হাজার কোটি টাকায় বাঁশাখালীর সাগরতীরে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ।

জমি বিক্রিতে বাধ্য করার স্থানীয়দের অভিযোগ অস্বীকার করে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ বলছেন, পরিবেশ দূষণের আশঙ্কারও কোনো ভিত্তি নেই।

জমি হারানোর ভয়, সূর্য না ওঠার গুজব

গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় সাগরতীরের জমিতে চলছে ‘এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট’ নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মাটি ভরাটের কাজ।

ওই এলাকার তিন কিলোমিটার উত্তরে মুজিবের টিলা এলাকায় পশ্চিম গণ্ডামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে মঙ্গলবার সংঘর্ষ বাঁধে।

এলাকাবাসীর দাবি, এনএসএন কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন এবং ভাইস-চেয়ারম্যান বাহাদুর আলম হিরণ এলাকার বাসিন্দাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে দিতে হবে বলে হুমকি দিয়ে আসছেন।

ভিটা রক্ষা কমিটির সদস্য আবু আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এস আলম গ্রুপের দালাল ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা এলাকায় এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষকে হুমকি দিচ্ছিল।

“তাদের লোকজন বলে বেড়াত- বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি থাকতে পারবে না। কৃষিকাজ করা মানুষ বসতভিটা আর লবণের জমি ছেড়ে কোথায় যাবে?”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, “এস আলম গ্রুপ টাকা আর ক্ষমতার জোরে সবার জমি কিনে নিয়েছে। সাধারণ মানুষ ভয়ে আর ভোগান্তিতে অর্ধেক দামে জমি বিক্রি করেছে।”

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমুদ্র তীরের গণ্ডামারার জমি লবণাক্ত হওয়ায় বছরের অধিকাংশ সময় এখানে লবণের চাষ হয়। বর্ষায় চিংড়ি এবং বছরে একবার শুধু ধানচাষ হয়।

নিহতের স্বজনদের আহাজারি

মঙ্গলবার সংঘর্ষে যে চারজন নিহত হন, তাদের দুজন মরতুজা আলী ও আনোয়ার ইসলামের ভাই বদি আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের কোনো জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে লবণ চাষ করেন তারা।

“প্রজেক্টে আমাদের কোনো জমি নেই। সবাই বলেছে পরিবেশ নষ্ট হবে। তাহলে আমরা বাড়িঘরে বসবাস করবে কেমনে? সেজন্য প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলাম,” বলেন বদি।

বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে বেকার হয়ে পড়বেন বলে শঙ্কা বদির মতো ওই গ্রামের অনেকের। সেইসঙ্গে নানা কুসংস্কারেও ওই এলাকার মানুষ বিশ্বাস করে বলে তাদের কথায় স্পষ্ট হয়েছে।

মোহাম্মদ আলী নামে একজন বলেন, “রক্ষা কমিটি বলেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে এখানে আর কখনও সূর্য উঠবে না। সারাবছর অন্ধকার থাকবে।

“সূর্য না উঠলে লবণও হবে না, গাছও হবে না। আমরা গরিব মানুষ ভিটা ছেড়ে কোথায় যাব? এজন্য প্রতিবাদ করেছি।”

আন্দোলনকারীদের নেতা লিয়াকত বলেন, “কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে বাড়ি ও জমি হারাতে হবে এই ভয়ে এবং পরিবেশ দূষণের আংশকায় সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করেছে। পুলিশের পোশাক পরে এস আলমের সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি করেছে।”

নিহতের ঘটনায় বিক্ষোভ

রাস্তা কেটে দিয়েছে গ্রামবাসী

নিহতের স্বজনদের সান্ত্বনা জানাতে মঙ্গলবার দুপুরে চরপাড়া গ্রামে মরতুজা আলীর বাড়িতে গিয়েছিলেন এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য শামীমা জান্নাত।

তিনি বলেন, “কোনো প্রতিবাদ সভায় এভাবে গুলি করে মানুষ মারতে আগে দেখিনি। কয়লা বিদ্যুৎ করতে হলে শত শত লাশের ওপর দিয়ে করতে হবে।”

‘লাশের উপর কয়লা বিদ্যুৎ চাই না’- শামীমা এই স্লোগান দিলে উপস্থিত কয়েকশ মানুষ তাতে কণ্ঠ মেলায়।

এর আগে বেলা ১২টার দিকে গণ্ডামারা রহমানিয়া সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার মাঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজারখানেক মানুষ জড়ো হয়। এদের অধিকাংশই ছিল নারী। তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেতে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন পশ্চিম গণ্ডামারার মাটির সংযোগ সড়কটিও কেটে দিয়েছে গ্রামবাসী। 

‘গুলি চালায় ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা’

স্থানীয়রা বলছেন, রোববার রাতে পুলিশ বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী সাতজনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে সোমবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মুজিবের টিলা এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষের একদলও সেখানে পাল্টা সমাবেশ ডাকলে উত্তেজনা এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল।

তারমধ্যেই ভিটা রক্ষা কমিটি দুপুরের পর মিছিল নিয়ে এগোলে সংঘাত বাঁধে বলে পুলিশ জানায়।    

সোমবার সংঘর্ষের আগের ছবি

চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) হাবিবুর রহমান বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধীরা সমাবেশ করতে চাইলে অন্য পক্ষের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধে। তা থামাতে গেলে পুলিশের উপর হামলা হয়। তখন পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়।

ঘটনা বর্ণনা করে বদি আহমদ বলেন, “আমরা স্কুলের কাছাকাছি গেলে পাঁচটি সিএনজি অটোরিকশা ও দুটি ট্রাকে ৫০-৬০ জন লোক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর হামলা চালায়।

“এরপর পুলিশ এসে টিয়ার সেল ছোড়ে। তখন গ্রামের লোকজন একসাথে হয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেয়।”

এনএসএন কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিনের উপস্থিতিতেই এই হামলা হয় বলে দাবি করেন বদি।

নিহত জাকের আহমদের ভাতিজা আনিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারাই শুরুতে গুলি করে। মিছিলের মানুষের মাথা ও বুক বরাবর তারা গুলি করেছে।”

পরে এলাকাবাসীর ধাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষের লোকজন ও পুলিশ গণ্ডামারা সেতুতে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে আরেক দফা গুলি চালানো হয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

এই ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন একটি কমিটিও করেছে।

‘লিয়াকতের উসকানি’

মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গণ্ডামারায় অবস্থান করে ঘটনাস্থল, কয়লা বিদ্যুৎ এলাকা ও নিহতদের বাড়ির কোথাও পুলিশ সদস্যদের দেখা যায়নি।

প্রকল্প এলাকায় জেটি নির্মাণের জন্য মাটি ভরাট কাজে ব্যবহৃত চারটি স্কেভেটরও অলস পড়ে থাকতে দেখা যায়।

নির্মাণ শ্রমিকদের থাকার জন্য অস্থায়ী ঘরটিতে তালা মারা। সেখানে এস আলম গ্রুপের কেউ নেই।

তবে পশ্চিম গণ্ডামারার প্রবেশমুখে ‘এস আলম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ অফিসে’ বেলা দেড়টার সময় গিয়ে ১০ জন পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়।

ওই অফিসে এনএসএন কনসোর্টিয়ামের কো-চেয়ারম্যান বাহাদুর আলম হিরণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সব নীতিমালা মেনে গত দু’বছর ধরে জমি কিনেছি। যারা জমি বিক্রি করেছে তাদের কোনো ক্ষোভ নেই।

রক্ষা কমিটির নেতা লিয়াকতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে হিরণ বলেন, গত বছর ৯২ কানি জমি কিনে দেওয়ার কথা বলে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন লিয়াকত। কিন্তু জমি বুঝিয়ে দেয়নি।

প্রকল্প এলাকা

“গত মাসে প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাট শুরু হলে লিয়াকত আরও এক কোটি টাকা দাবি করে। তা না দেওয়ায় সে গ্রামবাসীকে উসকে দিয়েছে।”

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গণ্ডামারা এলাকায় ৬০০ একর জমির পুরোটাই নিজেদের টাকায় কিনেছি। লোকজন খুশি হয়ে আমাদের কাছে জায়গা বিক্রি করেছে। জমি দখল করা হয়েছে এমন অভিযোগ স্থানীয়রা করেনি।”

গুলি ছোড়ার বিষয়ে হিরণ বলেন, “এস আলম গ্রুপের কেউ সেখানে যায়নি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষ-বিপক্ষের সাধারণ মানুষ সংঘর্ষে জড়ালে পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালায়।”

সাইফুল আলম বলেন, “যে জায়গায় ঘটনা, তা প্রকল্প এলাকা থেকে চার কিলোমিটার দূরে। এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ওই এলাকার কারও বিরোধ নেই। বাইরের লোকজন সেখানে হামলা করে থাকতে পারে।”

পরিবেশ দূষণ নিয়ে স্থানীয়দের শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, “বিশ্বের উন্নত অনেক জায়গায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। সেসব স্থানে দূষণ হয়নি, সুতরাং এখানেও হবে না।”

শঙ্কায় লিয়াকত

বিএনপির চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটির সদস্য লিয়াকত আলী এই আন্দোলনের কারণে সরকারের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা করছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যিনি বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে চেয়েছেন, তিনি রাঘব বোয়াল। সরকারদলীয় লোকজন তার কাছ থেকে নানাভাবে সুবিধা নিয়েছে। তারা কি আমাকে ছেড়ে দেবে?

“আমি যে কোনো সময় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হতে পারি। গুম-খুন হতে পারি। সরকারের কাছে আহ্বান, কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেন এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা না হয়।”

নিহত মরতুজা আলীর ভাইয়ের করা মামলায় দুবার নির্বাচিত বিএনপি নেতা লিয়াকতকেও আসামি করা হয়েছে।