বুধবার দুপুরে দুই পক্ষের এই সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। সংঘর্ষের পর ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৪০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সংঘর্ষের সময় কলেজের অধ্যক্ষ জেসমিন আক্তার কলেজ মিলনায়তনে আটকা পড়েন। সেখানে কলেজ কর্তৃপক্ষের আয়োজনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান চলছিল।
সংঘর্ষের পর বিকালে কলেজ কর্তৃপক্ষ চারটি ছাত্রাবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়।
দুপুরে চট্টগ্রাম কলেজে সংঘর্ষের পর বিকালে পাশের হাজি মহসিন কলেজের একাডেমিক ভবন ও ল্যাবরেটরি ভাংচুর করে এক দল তরুণ।
এরপর কলেজের দুটি ছাত্রাবাস (মহসিন মুসলিম ছাত্রাবাস ও নতুন ছাত্রাবাস) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বলে কলেজটির অধ্যক্ষ অঞ্জন নন্দি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
বন্দর নগরীতে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম কলেজ ও মুহসিন কলেজ দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতেও অন্য ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা নেই।
বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতেও কলেজ কর্তৃপক্ষের বাইরে শুধু ছাত্রশিবির শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আসছিল। বুধবার ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম কলেজ শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার পরই সংঘর্ষ বাঁধে।
চকবাজার থানার ওসি আজিজ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেলা ১২টার দিকে কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ক্যাম্পাসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করার সময় শিবিরকর্মীরা হামলা চালায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ছাত্রলীগ ফুল দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার পরপরই একাডেমিক ভবনের দিকে হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর শহীদ মিনারে থাকা ছাত্রলীগকর্মীদের দিকে ইট ছোড়া হয়।
তখন শিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। দুই পক্ষই বৃষ্টির মতো একে অন্যের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকে বলে কলেজের এক কর্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
তিনি বলেন, “এভাবে ১০/১৫ মিনিট চলার পর শিবিরের কর্মীরা ক্যাম্পাসের ভেতরের দিকে গিয়ে প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ছাত্রলীগের ছেলেরা কলেজের বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে, সড়ক থেকে ইট ছোড়ে।”
এর ২০/২৫ মিনিট পর পুলিশ এসে কলেজের মূল ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে অভিযান চালায়। তখন কলেজ সংলগ্ন রাস্তায় ছাত্রলীগকর্মীরা থেমে থেমে মিছিল করছিল।
পুলিশের পর ছাত্রলীগের কর্মীদেরও ভেতরে ঢুকে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করতে দেখা গেছে।
সংঘর্ষের সময় উভয়পক্ষের ছোড়া ইটে কলেজের মূল ভবন, মিলনায়তনের জানালার বেশ কয়েকটি কাচ ভেঙে যায়। এসময় মিলনায়তনে চলা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যায়।
অধ্যক্ষ জেসমিন আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনুষ্ঠানের সময় বাইরে গোলমাল হয়েছে। কারা করেছে, আমরা জানি না। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরুর আগেই এ সংঘর্ষ হয়।
“ভেতরে আমিসহ চারশ’ জনের বেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী আটকে ছিলাম। নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা বের হইনি। পুলিশ এলে বেলা ২টার দিকে আমরা বের হয়ে আসি।”
সংঘর্ষের পর বিপুল পরিমাণ র্যাব ও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। বেলা সোয়া ২টার দিকে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসে।
সংঘর্ষের পর বিপুল পরিমাণ পুলিশ ও র্যাব সদস্য গিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে অভিযান চালায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর পুলিশ ভেতরে ঢুকে।
দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত কলেজে অভিযান চালিয়ে শিবিরকর্মী সন্দেহে অন্তত ৪০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানান নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) দেবদাস ভট্টাচার্য।
চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংঘর্ষের সময় পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।”
সংঘর্ষের জন্য শিবিরকে দায়ী করে সরকার সমর্থক সংগঠনের এই নেতা বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে এখানে শিবির আধিপত্য চালাচ্ছে। অন্য কোনো সংগঠনকে রাজনীতি করতে দেয় না। আমরা শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার পর শিবিরের ছেলেরা আমাদের উপর নির্লজ্জভাবে হামলা করেছে।”
এই বিষয়ে ছাত্রশিবিরের কোনো নেতার বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
দুটি হলে তল্লাশি, গ্রেপ্তার ৪০
সংঘর্ষের পর বিকালে শিবির নিয়ন্ত্রিত সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা ছাত্রাবাসে তল্লাশি চালায় পুলিশ।
এসময় এ দুটি হলের প্রত্যেকটি কক্ষ তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। তালা ভেঙে তল্লাশি চালালেও কিছু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
তল্লাশি শুরুর আগে শিবির নিয়ন্ত্রিত হলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার দাবিতে কলেজ অধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখে ছাত্রলীগের কর্মীরা।
পরে পুলিশ অধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনে থেকে তাদের সরিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্যাম্পাস থেকে শিবিরকর্মী সন্দেহে ৪০ জনের মতো আটক করা হয়েছে। পরে তাদের যাচাই বাছাই করা হবে।”
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “শিবির সন্দেহের আটকের সংখ্যা ৫০ জনের কম হবে না।”
পুলিশ কর্মকর্তা দেবদাস বলেন, বিকালে কলেজ ছাত্রাবাসে অভিযান চালানোর পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
তদন্ত কমিটি
সংঘর্ষের পর বিকালে চট্টগ্রাম কলেজ কর্তৃপক্ষ একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক করে চারটি আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।
এছাড়া ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে জানান কলেজ অধ্যক্ষ জেসমিন আক্তার।
তিনি বলেন, “ছাত্রদের আজ (বুধবার) রাত ৮টার মধ্যে এবং ছাত্রীদের কাল (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
চট্টগ্রাম কলেজের শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও সবুর হোস্টেল নামে তিনটি ছাত্র এবং খাদিজাতুল কোবরা নামে একটি ছাত্রী হোস্টেল রয়েছে।