‘সুপার হিউম্যান’ স্টোকস

২২ গজে মনে রাখার মতো কীর্তি বেশ কিছুই গড়েছেন। তবু বেন স্টোকসের দুটি ছবিই যেন লোকের মনে বেশি জায়গা করে নিয়েছিল। টানা চার বলে ছক্কা হজম করে হাঁটু মুড়ে মুখ ঢেকে আছেন হাত দিয়ে। আর ব্রিস্টলের নাইট ক্লাবে মারামারি করে ধরা পড়েছেন পুলিশের হাতে। এবারের বিশ্বকাপ যেন স্টোকসের কাছে এই ছবিগুলো ভুলিয়ে দেওয়ার অভিযান, যেটি পূর্ণতা পেল ফাইনালে। এতটাই অসাধারণ পারফরম্যান্স যে দলের অধিনায়ক তাকে বলছেন, ‘সুপার হিউম্যান।’

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিলন্ডন থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2019, 07:05 AM
Updated : 15 July 2019, 09:35 AM

বিশ্বকাপ ফাইনালের ফয়সালা শেষ পর্যন্ত হয়েছে বাউন্ডারি সংখ্যায়। তবে সেই চূড়ান্ত ধাপ পর্যন্ত নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে ইংল্যান্ড সমান তালে থাকতে পেরেছে স্টোকসের সৌজন্যেই।

রোববার লর্ডসের ফাইনালে রান তাড়ায় যখন ধুঁকছিল ইংল্যান্ড, জস বাটলারের সঙ্গে স্টোকসের জুটিতে ঘুরে দাঁড়ায় দল। বাটলারের বিদায়ের পর স্টোকস একরকম একাই টানেন দলকে। অপরাজিত থাকেন ৯৮ বলে ৮৪ রানে।

লম্বা ইনিংস শেষে ক্লান্তি ভুলে সুপার ওভারেও তিনি ছিলেন ‘সুপার’। ম্যান অব দা ফাইনালের বিবেচনায় তার কাছাকাছিও ছিল না আর কেউ।

শুধু ফাইনালেই নয়, টুর্নামেন্ট জুড়েই স্টোকস ছিলেন ব্যাটে-বলে উজ্জ্বল। ৬৬.৪২ গড়ে রান করেছেন ৪৬৫, উইকেট নিয়েছেন ৭টি। ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর স্টোকস ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট হলেও বিস্ময়কর কিছু হতো না।

অথচ এই বিশ্বকাপের সময় তিনি থাকতে পারতেন জেলে। কিংবা দলের বাইরে। ক্রিকেট থেকে অনেক দূরে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের সময় ব্রিস্টলে নাইটক্লাবের বাইরে মারামারির ঘটনা গ্রেপ্তার করা হয় তাকে সতীর্থ অ্যালেক্স হেলসসহ।

এরপর থানা-পুলিশ, আদালতে ছুটোছুটি করতে হয়েছে। দলে জায়গা হারিয়েছেন। নিষিদ্ধ হয়েছেন। পেতে হয়েছে শৃঙ্খলাভঙ্গের শাস্তি। ক্যারিয়ারই এক সময় মনে হচ্ছিল অনিশ্চিত।

তার প্রতিভা, তার ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতার কারণেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে বারবার। এই দফায়ও যেমন পেয়েছেন সুযোগ। এবার কাজে লাগাচ্ছেন দারুণভাবে। গোটা টুর্নামেন্টে তার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স পূর্ণতা পেয়েছে যেন ফাইনালে। ম্যাচ শেষে অধিনায়ক ওয়েন মর্গ্যান জানালেন মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া।

“যত কিছু পেরিয়ে সে এখানে এসেছে, তা অসাধারণ কিছু। সে প্রায় সুপার হিউম্যান। দলকে বয়ে নিয়েছে সে, আমাদের ব্যাটিং লাইন আপ বয়ে নিয়েছে। জসের সঙ্গে ওর জুটি তো দারুণ ছিলই, তবে পরে লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে যেভাবে খেলেছে, সেটা ছিল অবিশ্বাস্য।”

“আবহ যেমন ছিল, গোটা ম্যাচে যেমন আবেগের স্রোত ছিল, সেটার সঙ্গে দারুণ অভিজ্ঞের মতো মানিয়ে নিয়েছে।”

মাঠের বাইরের ওই লজ্জার ঘটনার আগে তার বিব্রতকর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল মাঠের ক্রিকেটে। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে কলকাতায় শেষ ওভারটি বোলিং করতে তাকে ডেকেছিলেন অধিনায়ক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ছিল ১৯ রান। ইংল্যান্ডের শিরোপা জয় মনে হচ্ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তার প্রথম চার বলেই ছক্কা মেরে ম্যাচ শেষ করে দেন কার্লোস ব্র্যাথওয়েট।

সেই অভিজ্ঞতা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আরও বড় আসরের ফাইনালে দলের জয়ের নায়ক হতে যে মানসিক শক্তি লাগে, সেটি মনে করিয়ে দলেন মর্গ্যান।

“বেনকে নিয়ে এটি আমি অনেকবারই বলেছি। কলকাতায় যা হয়েছিল, এরকম কিছু হলে অনেকের ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে যায়। বেন সেখানে অসংখ্যবার দাঁড়িয়ে গেছে দলের প্রয়োজনে। ট্রেনিংয়ে সে সামনে থাকে, টিম মিটিংয়েও অগ্রনী থাকে। অবিশ্বাস্য এক ক্রিকেটার সে। আজকে ওর দারুণ একটি দিন ছিল, ওর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।”

বিতর্কিত অধ্যায়কে পেছনে ফেলে মাঠে ফেরার পর গত এপ্রিলে একটি সাক্ষাৎকারে স্টোকস বলেছিলেন, “আমি এমন কিছু করতে চাই যেন লোকে আমাকে মাঠের পারফরম্যান্সে মনে রাখে। বিশ্বকাপ জিতলে তো আমাকে নিয়ে বলতে গেলে এটিই প্রথমে থাকবে? ঠিক আছে। রাস্তায় মারামারি করেছে, এমন একজন হিসেবে আমি পরিচিত হয়ে থাকতে চাই না।”

পরিচয় বদলানোর কাজটা এর চেয়ে ভালোভাবে আর বুঝি করতে পারতেন না স্টোকস! তাকে নিয়ে শেষ কথায় তাই যথার্থই বললেন মর্গ্যান, “ঘরে বসে যারা স্টোকসকে দেখছো, আশা করি সবাই চেষ্টা করবে পরবর্তী বেন স্টোকস হতে!”