জাদেজার জাদু থামিয়ে ফাইনালে নিউ জিল্যান্ড

ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য এক গল্প প্রায় লিখে ফেলেছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা। আটে নেমে ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস খেলেও দলকে এনে দিতে পারলেন না রূপকথার জয়। রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে জিতে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠল নিউ জিল্যান্ড।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিম্যানচেস্টার থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2019, 09:54 AM
Updated : 10 July 2019, 03:15 PM

নিষ্প্রাণ হয়ে পড়া ম্যাচে প্রাণ ফিরিয়েছিল জাদেজা ও মহেন্দ্র সিং ধোনির অসাধারণ জুটি। কিন্তু দুর্দান্ত বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে ভারতকে হতাশ করে কিউইরাই হাসল শেষ হাসি। বৃষ্টিতে রিজার্ভ ডেতে গড়ানো ম্যাচে ১৮ রানের জয়ে তারা পা রাখল ফাইনালের মঞ্চে।
 
বারবার সেমি-ফাইনাল থেকে বাদ পড়ে এক সময় সেমি-ফাইনালের দল হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল নিউ নিউজিল্যান্ড। ফাইনালের সঙ্গে আড়ি অবশেষে কেটে যায় গত বিশ্বকাপে। এবার তারা টানা দ্বিতীয়বার জায়গা করে নিল ফাইনালে। 
 
২০১১ সালে দেশের মাটিতে শিরোপা জয়ের পর ভারত টানা দ্বিতীয়বার বিদায় নিল বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল থেকে।
 
মাঝারি রান তাড়ায় ভারতের শক্তিশালী টপ অর্ডার এ দিন উড়ে গিয়েছিল তাসের ঘরের মতো। মিডল অর্ডারেও হয়নি প্রতিরোধ। ৯২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে তারা গুনতে থাকে বিদায়ের প্রহর।
 
বিদায় শেষ পর্যন্ত নিতেই হয়েছে। তার আগে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় জাদেজা জিইয়ে তুলেছিলেন নাটকীয় জয়ের স্বপ্ন। সারথী ছিলেন অভিজ্ঞ ধোনি। সপ্তম উইকেটে বিশ্বকাপের রেকর্ড ১১৬ রানের জুটি গড়েন দুজন। কিন্তু সেটি ম্যাচ জেতানো জুটি হয়ে ওঠেনি। প্রবল চাপের মধ্যে স্নায়ু ধরে রেখে শেষের সময়টা জিতেছে কিউইরা। ৫৯ বলে ৭৭ রান করে জাদেজা ৪৮তম ওভারে বিদায় নিয়েছেন ট্রেন্ট বোল্টকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে। মার্টিন গাপটিলের সরাসরি থ্রোয়ে ধোনি থেমেছেন ৫০ রানে। জিতেছে নিউ জিল্যান্ড।
 
সেই জয়ের ভিত নতুন বলে গড়ে দিয়েছিলেন বোল্ট ও ম্যাট হেনরি। নিজেদের যা পুঁজি ছিল, জিততে হলে ভারতের টপ অর্ডারকে দ্রুত ফেরানোর বিকল্প ছিল না। দুর্দান্ত পরিকল্পনা আর নিখুঁত বাস্তবায়নে দুজন গুঁড়িয়ে দেন টপ অর্ডার।
 
এবারের আসরে রেকর্ড পাঁচটি সেঞ্চুরি করা রোহিত শর্মাকে দিয়ে শুরু। হেনরির অফ স্টাম্প ঘেষা বলে খুব বেশি কিছু করার ছিল না রোহিতের।

বিরাট কোহলিকে অফ স্টাম্পের বাইরে পরীক্ষা নিয়ে বোল্ট এলবিডব্লিউ করে দেন একটু সুইং করে ভেতরে ঢোকা বলে। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে বাঁচতে পারেননি ভারত অধিনায়ক। রিভিউয়ে দেখা যায়, বল লাগতো বেলসে। স্তব্ধ কোহলি বেশ কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন উইকেটে।
 
কোহলি ড্রেসিং রুমে গিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখেন, পিছু নিয়েছেন লোকেশ রাহুল। হেনরির বলে এই ওপেনার ক্যাচ দিয়েছেন উইকেটের পেছনে। 
 
তিন জনই ফিরেছেন ১ রানে। চতুর্থ ওভারে ভারতের রান তখন ৩ উইকেটে ৫। টিভি পর্দায় ফুটে ওঠা কোহলির পাথুরে চেহারা বলে দিচ্ছিল, পরিণতি যেন বুঝতে পারছেন।
 
ধুঁকতে থাকা দিনেশ কার্তিককেও ফিরিয়ে দেন হেনরি। ২১ বল খেলে প্রথম রানের দেখা পাওয়া ব্যাটসম্যান আউট হন পয়েন্টে জিমি নিশামের চোখধাঁধানো ডাইভিং ক্যাচে।
 
রিশাভ পান্ত ও হার্দিক পান্ডিয়া চেষ্টা করেছেন লড়াইয়ের। দুজনই ফিরেছেন ৩২ রানে, দুজনই মিচেল স্যান্টনারকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে। 
 
স্যান্টনারের বাঁহাতি স্পিনের কোনো জবাবই তখন জানা নেই ভারতের। এক পর্যায়ে তার বোলিং ফিগার ছিল ৬-২-৭-২!
 
সেই স্যান্টনারকেই পরে দুই দফায় গ্যালারিতে ফেলেন জাদেজা। আটে নেমে শুরু থেকেই ভয়ডরহীন মানসিকতায় ব্যাট করতে থাকেন এই অলরাউন্ডার। ধোনি যথারীতি এক প্রান্ত আগলে রেখে টানতে থাকেন ইনিংস। একটু একটু করে ম্যাচে ফেরে প্রাণ। ভারতীয় সমর্থকে ঠাসা গ্যালারি হয়ে ওঠে উত্তাল।
 
৩৯ বলে ফিফটি স্পর্শ করেন জাদেজা। ওয়ানডেতে সবশেষ ফিফটি পেয়েছিলেন তিনি সেই ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে, এই ইংল্যান্ডেই; হেডিংলিতে, ইংলিশদের বিপক্ষে। 
 
জাদেজা এগিয়ে যাচ্ছিলেন ফিফটির পরও। কিন্তু রান বলে টানাপোড়েন বাড়ছিল। তাকে বড় শট খেলতেই হতো। সেই চেষ্টাতেই আউট হয়ে যান।

২ ওভারে যখন প্রয়োজন ৩১, লকি ফার্গুসনকে আপার কাটে ছক্কায় ওড়ান ধোনি। এক বল পরই শেষ হয় তার লড়াই। দুই রানের চেষ্টায় প্রথম রানে ফিফটি স্পর্শ করেন, দ্বিতীয় রানে স্পর্শ করতে পারেননি ক্রিজ। ভারতের আশা শেষ হয়ে যায় গাপটিলের সরাসরি থ্রোয়ে।
 
অথচ প্রথম ইনিংস শেষে ভারতের আশাই ছিল বেশি সজীব। নিউ জিল্যান্ড গড়তে পারেনি বড় স্কোর। 
 
ভারতের দুর্দান্ত বোলিং সামলে কেন উইলিয়ামসন ও রস টেইলের লড়াইয়ে আগের দিন ৪৬.১ ওভারে ৫ উইকেটে ২১১ রান তুলেছিল নিউ জিল্যান্ড।

৬৭ রানে অপরাজিত থাকা টেইলর রিজার্ভ ডেতে হাত খুলতে পারেননি। রান আউট হয়ে যান ৭৪ রানে। 
 
শেষ দিকে ঝড় তুলতে পারেনি কেউ। এ দিনের ২৩ বলে আসে কেবল ২৮ রান। চার এসেছে কেবল একটি। 
 
অসাধারণ বোলিং-ফিল্ডিং, দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা আর বিশ্বাস নিয়ে সেই রানকেই জয়ের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ করল নিউ জিল্যান্ড। শেষ দল হিসেবে সেমি-ফাইনালে উঠেও তারা হারিয়ে দিল প্রাথমিক পর্বে অপ্রতিরোধ্য মনে হওয়া ভারতকে। 
 
কিউইদের সামনে এখন আবারও প্রথম শিরোপার হাতছানি। ভারতের অপেক্ষা চার বছরের, আবার বসবে তাদের দেশে বিশ্বকাপ। 
 
সংক্ষিপ্ত স্কোর: 
 
নিউ জিল্যান্ড: ৫০ ওভারে ২৩৯/৮ (গাপটিল ১, নিকোলস ২৮, উইলিয়ামসন ৬৭, টেইলর ৭৪, নিশাম ১২, ডি গ্র্যান্ডহোম ১৬, ল্যাথাম ১০, স্যান্টনার ৯*, হেনরি ১, বোল্ট ৩*; ভুবনেশ্বর ১০-১-৩৪-৩, বুমরাহ ১০-১-৩৯-১, পান্ডিয়া ১০-০-৫৫-১, জাদেজা ১০-০-৩৪-১, চেহেল ১০-০-৬৩-১)।

ভারত: ৪৯.৩ ওভারে ২২১ ( রাহুল ১, রোহিত ১, কোহলি ১, পান্ত ৩২, কার্তিক ৬, পান্ডিয়া , ধোনি ৫০, জাদেজা ৭৭, ভুবনেশ্বর ০, চেহেল ৫, বুমরাহ ০*; বোল্ট ১০-২-৪২-২, হেনরি ১০-১-৩৭-৩, ফার্গুসন ১০-০-৪৩-১, ডি গ্রান্ডহোম ২-০-১৩-০, নিশাম ৭.৩-০-৪৯-১, স্যান্টনার ১০-২-৩৪-২)।
 
ফল: নিউ জিল্যান্ড ১৮ রানে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: ম্যাট হেনরি