ভারতের কাছে হেরে সেমি-ফাইনাল স্বপ্নের সমাধি

নুয়ে পড়া শরীর। নত হয়ে আসা মাথা। রণে ভঙ্গ দিয়ে একেকজন ব্যাটসম্যান উইকেট ছেড়ে গেলেন আর একটু একটু করে হারিয়ে গেল বাংলাদেশের স্বপ্ন। লক্ষ্যটাকে নাগালে পেয়েও ছোঁয়া হলো না। উত্থান-পতনের বিশ্বকাপ থেকে নিশ্চিত হয়ে গেল বাংলাদেশের বিদায়।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবার্মিংহাম থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2019, 01:51 PM
Updated : 2 July 2019, 07:01 PM

বাংলাদেশের শেষ চারের আশা গুঁড়িয়ে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করল ভারত। বার্মিংহামে মঙ্গলবার ভারতীয় সমর্থকে ঠাসা গ্যালারিকে উত্তাল করে দুইবারের চ্যাম্পিয়নরা জিতল ২৮ রানে।

পরাজয়ের ব্যবধান হয়তো খুব বড় মনে হচ্ছে না, তবে ম্যাচের উত্তেজনা অনেকটা শেষ হয়ে গেছে আসলে ম্যাচ শেষের বেশ আগেই। মূল ব্যাটসম্যানদের আলগা শটের মিছিলে বাংলাদেশের রান তাড়া জমে ওঠেনি সেভাবে।

বাংলাদেশের দুর্দশার শুরু ম্যাচের শুরুর দিকেই। ৯ রানে রোহিত শর্মার ক্যাচ ছাড়েন তামিম ইকবাল। জীবন পেয়ে ভারতীয় ওপেনার করেন রেকর্ড ছোঁয়া সেঞ্চুরি। ভারতের শুরুটা হয় দুর্দান্ত।

মুস্তাফিজুর রহমানের ৫ উইকেটের সৌজন্যে পরে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ভারতকে আটকে রাখা গেল ৩১৪ রানে। এই উইকেটে লক্ষ্য ছোঁয়া ছিল খুবই সম্ভব। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সেটিকে অসম্ভব করে তুললেন নিজেরাই। দুই ওভার বাকি থাকতে তাই ইনিংস শেষ ২৮৬ রানে।

৮ ম্যাচে ৩ জয় আর একটি পরিত্যক্ত ম্যাচ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ৭ পয়েন্ট। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি এখন আনুষ্ঠানিকতার। কিংবা পয়েন্ট টেবিলে অবস্থান একটু ভালো করার।

এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসান আবারও ছড়িয়েছেন আলো। দারুণ বোলিংয়ের পর ব্যাট হাতে করেছেন ফিফটি। কিন্তু বাকি ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতাই ছিটকে দিয়েছে দলকে।

৩১৫ রান তাড়ায় প্রয়োজন ছিল গোছানো ব্যাটিং। কিন্তু গুছিয়ে উঠতে উঠতেই একের পর এক ব্যাটসম্যান বিলিয়ে এসেছেন উইকেট। প্রথম ৫ ব্যাটসম্যানই ছাড়িয়েছেন ২০, ফিফটি কেবল সাকিবের। প্রথম চার জুটি ছুঁয়েছে ৩৫, পঞ্চাশে যায়নি একটিও। ম্যাচ হার একরকম নিশ্চিত হয়ে যায় তাতেই।

রান তাড়ার শুরুটা যদিও ছিল আশা জাগানিয়া। দারুণ তিনটি বাউন্ডারিতে তামিমের ব্যাটে ছিল শুভ ইঙ্গিত। রানের স্রোত তীব্র না হলেও উইকেট ধরে রাখা উদ্বোধনী জুটিতে ছিল আশার জোয়ার।

ভাটার টান আসার শুরু তামিমকে দিয়েই। দশম ওভারে স্টাম্পে টেনে আনলেন মোহাম্মদ শামির বাইরের বল। এই বিশ্বকাপে ষষ্ঠবার দুই অঙ্ক ছুঁয়ে বাংলাদেশের সফলতম ব্যাটসম্যান যেতে পারলেন না ফিফটিতে।

এরপর চলতে থাকল পুনরাবৃত্তি। একেকজন ব্যাটসম্যান থিতু হলেন। ভালো খেলতে খেলতেই রণে ভঙ্গ দিলেন আলগা শটে। অপমৃত্যু হতে থাকল একেকটি সম্ভাবনাময় জুটির।

সৌম্য সরকার, মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, সবাই আউট হলেন ৩০ গজ বৃত্তের ভেতর ক্যাচ দিয়ে। বাইরের বল স্টাম্পে টানলেন মোসাদ্দেক হোসেন।

আশার বাতি হয়ে ছিলেন সাকিব। বিশ্বকাপে ৭ ইনিংসে ষষ্ঠবার পেরিয়ে যান ফিফটি। কিন্তু ৬৬ রানে সেই আলো নিভে যায় হার্দিক পান্ডিয়ার স্লোয়ারে। ব্যাটিংয়ে শূন্য রানে ফেরা পান্ডিয়ার সেটি তৃতীয় উইকেট!

সাব্বির রহমান ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন এরপর লড়াই করেছেন। একটু হলেও জাগিয়ে তুলেছেন আশা। তবে জাসপ্রিত বুমরাহ বোলিংয়ে ফিরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন ডেথ ওভারে তিনি বিশ্বের সেরা বোলার।

সাইফের ৩৮ বলে ৫১ রানের অপরাজিত ইনিংসটি তার ভবিষ্যতের উজ্জ্বল বার্তা দিল বটে, তবে বিশ্বকাপে দলের ভবিষ্যৎ তখন আর কিছু নেই।

সকালে বাংলাদেশের হতাশার শুরু টস হার দিয়ে। সেই রেশ আরও দীর্ঘায়িত হলো তামিমের ক্যাচ মিসে। মুস্তাফিজের বলে পুল করেছিলেন রোহিত, স্কয়ার লেগ থেকে মিড উইকেটের দিকে ছুটে বলের নিচে গেলেও তামিম পারেননি হাতে জমাতে।

বিশ্বকাপে এবার আগের তিন সেঞ্চুরির দুটিতেই শুরুর দিকে জীবন পেয়েছিলেন রোহিত। এই ম্যাচেও সেটির চড়া মূল্য বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে। ৭ চার ও ৫ ছক্কায় ৯২ বলে করেছেন ১০৪।

এবারের আসরে রোহিতের যেটি চতুর্থ সেঞ্চুরি। এক বিশ্বকাপে চারটি সেঞ্চুরি আছে কেবল আর কুমার সাঙ্গাকারার।

লোকেশ রাহুলের সঙ্গে রোহিতের উদ্বোধনী জুটিতে ভারত তোলে ১৮০ রান। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম জুটিতে সর্বোচ্চ রান এটিই।

ওই ক্যাচ ছাড়া তেমন কোনো সুযোগ আর তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। কেবল সাকিব ছাড়া শুরুর দিকে কারও বোলিংয়ে ছিল না ধার। ১০৫ বলে আসে জুটির শতরান, পরের পঞ্চাশে লাগে কেবল ৩৫ বল।

রোহিত ফিফটি স্পর্শ করেন ৪৫ বলে। পরের পঞ্চাশেও লেগেছে ঠিক ৪৫ বল। এই বিশ্বকাপে এটি তার চতুর্থ ও ওয়ানডেতে ২৬তম সেঞ্চুরি।

অনেক সময়ই সেঞ্চুরির পর আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন রোহিত। এ দিন সুযোগটি দেননি সৌম্য সরকার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের মতো আবারও দলকে ব্রেক থ্রু এনে দেন এই অনিয়মিত বোলার। তার স্লোয়ার উড়িয়ে মারতে গিয়ে ফেরেন রোহিত।

সঙ্গীকে হারানোর পর বেশি দূর যেতে পারেননি রাহুল। স্লোয়ারে ফেরেন তিনিও। ৯২ বলে ৭৭ রান করা ওপেনার বিশ্বকাপে এবার রুবেলের প্রথম শিকার।

চোখধাঁধানো কয়েকটি শটে বিরাট কোহলির রান রথ ছুটতে শুরু করেছিল। ইনিংসের বাংলাদেশের সেরা সময়টুকু আসে তখনই। মুস্তাফিজের দুটি কাটার দলকে উপহার দেয় দুটি উইকেট। পুল শট সীমানায় সোজা ফিল্ডারের হাতে তুলে দেন কোহলি। নতুন ব্যাটসম্যান হার্দিক পান্ডিয়া দ্বিতীয় বলেই শূন্য রানে ফেরেন স্লিপে সৌম্য সরকারের দারুণ ক্যাচে।

ডাবল উইকেট মেডেনে যে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন মুস্তাফিজ, পরের ওভারে সাইফকে টানা তিন বাউন্ডারিতে তা আলগা করে দেন রিশাভ পান্ত।

৪১ বলে ৪৮ রান করা পান্তকে পরে বিদায় করেন ইনিংস জুড়ে দারুণ বোলিং করা সাকিব। অনেকটা কমে আসে ভারতের রানের গতি। শেষ পর্যন্ত  মহেন্দ্র সিং ধোনির ৩৩ বলে ৩৫ ভারতকে নিয়ে যায় তিনশর ওপারে।

শেষ ১০ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ভারত তুলতে পারে ৬৩ রান। শেষ ওভারে দুটি উইকেট নিয়ে মুস্তাফিজ পূরণ করেন ৫ উইকেট।

এই প্রথম বিশ্বকাপে ৫ উইকেট পেলেন বাংলাদেশের কোনো পেসার। ক্যারিয়ারের প্রথম ৯ ওয়ানডেতেই ৩ বার ৫ উইকেট নেওয়া মুস্তাফিজ আরেকটি ৫ উইকেটের স্বাদ পেলেন ৪৩ ম্যাচ পর।

তখনও বেঁচে বাংলাদেশের আশা। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা বইতে পারলেন না ভার। ম্যাচ শেষ হতেই গ্যালারির গর্জনের মাঝে যখন উল্লাস করছে ভারতীয় ক্রিকেটাররা, অপরাজিত ব্যাটসম্যান সাইফ তাকিয়ে রইলেন অসহায় চোখে। সেটি যেন গোটা বাংলাদেশেরই দৃষ্টি!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ভারত: ৫০ ওভারে ৩১৪/৯ (রাহুল ৭৭, রোহিত ১০৪, কোহলি ২৬, পান্ত ৪৮, পান্ডিয়া ০, ধোনি ৩৫, কার্তিক ৮, ভুবনেশ্বর ২, শামি ১, বুমরাহ ০*; মাশরাফি ৫-০-৩৬-০, সাইফ ৭-০-৫৯-০, মুস্তাফিজ ১০-১-৫৯-৫, সাকিব ১০-০-৪১-১, মোসাদ্দেক ৪-০-৩২-০, রুবেল ৮-০-৪৮-১, সৌম্য ৬-০-৩৩-১)।

বাংলাদেশ: ৪৮ ওভারে ২৮৬ (তামিম ২২, সৌম্য ৩৬, সাকিব ৬৬, মুশফিক ২৪, লিটন ২২, মোসাদ্দেক ৩, সাব্বির ৩৬, সাইফ ৫১*, মাশরাফি ৮, রুবেল ৯, মুস্তাফিজ ০; ভুবনেশ্বর ৯-০-৫১-১, বুমরাহ ১০-১-৫৫-৪, শামি ৯-০-৬৮-১, চেহেল ১০-০-৫০-১, পান্ডিয়া ১০-০-৬০-৩)।

ফল: ভারত ২৮ রানে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: রোহিত শর্মা