হয়তো শঙ্কা থেকেই বাংলাদেশকে সফরে নেয় না অস্ট্রেলিয়া: ফ্লেমিং

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগের দিন ডেমিয়েন ফ্লেমিংকে দেখা গেল ট্রেন্ট ব্রিজে। গলায় ঝোলানো অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড। ক্যামেরা-মাইক্রোফোনের সামনে কথা বললেন, কাজ করছেন একটি ইংলিশ ওয়েবসাইটে। বাংলাদেশের সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়ে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে চাইতেই রাজি হয়ে গেলেন। শর্ত দিলেন, কেবল ৫ মিনিট কথা বলবেন শুধু বিশ্বকাপ নিয়ে। পরে অবশ্য সাবেক এই অস্ট্রেলিয়ান পেসার সময় দিলেন আরেকটু বেশি, কথা বললেন আরও কিছু বিষয় নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিনটিংহ্যাম থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2019, 03:25 AM
Updated : 20 June 2019, 10:11 AM

ট্রেন্ট ব্রিজে পা রাখলে সবার আগে কি মনে পড়ে?

ডেমিয়েন ফ্লেমিং: এখানেই আমি আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের একমাত্র ছক্কাটি মেরেছি! যতটা মনে পড়ে, এই দিক দিয়ে (সোজাসুজি বাউন্ডারি দেখিয়ে)। বোলার ছিল সাকলায়েন মুশতাক। আমার ধারণা, আমার কাছে ছক্কা হজম করেই তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে!

বাংলাদেশকে কেমন দেখছেন? কেমন হতে পারে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ম্যাচ?

ফ্লেমিং: বাংলাদেশ দারুণভাবে এগোচ্ছে, তাই না? সম্ভাব্য সেমি-ফাইনাল সবাই ধরে নিয়েছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও হয়তো নিউ জিল্যান্ড। তবে বাংলাদেশ সবাইকে চমকে সেমিতে জায়গা করে নিতেও পারে! এই দলের যে বিশেষত্ব আমার চোখে পড়েছে, তারা আত্মবিশ্বাসী। বিশ্বাস করে যে জিততে পারে।

বাংলাদেশের বোলিং লাইন আপ, আমার মতে, একদম ফার্স্ট ক্লাস নয়। তবে এই বিশ্বকাপে খুব বেশি দলের বোলিং আক্রমণ ফার্স্ট ক্লাস নয়। সব দলের পরিকল্পনা ব্যাটিং ঘিরে, তিনশ রান করা বা তাড়া করা। এই বাংলাদেশ দলের সেই বিশ্বাস আছে বলে মনে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার জন্য তাই বিপজ্জনক একটি ম্যাচ অপেক্ষা করছে।

বিশ্বকাপের আগেও কি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনুসরণ করা হয়েছে?

ফ্লেমিং: অস্ট্রেলিয়া যখন খেলেছে, দেখেছি। অস্ট্রেলিয়া যখন বাংলাদেশে টেস্ট সিরিজ খেলতে গিয়েছিল (২০১৭), তাদের কন্ডিশনে বেশ ধুঁকেছিল। বাংলাদেশ দারুণ খেলে একটি টেস্ট জিতেছিল।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সত্যিকারের হতাশার মুহূর্ত ছিল সম্ভবত বাংলাদেশের বিপক্ষে জেসন গিলেস্পির ডাবল সেঞ্চুরি! সে সব সময় ডাবল সেঞ্চুরির কথা বলতে বলতে কান ঝালাপালা করে দেয়। জানি না, কোন কুক্ষণে যে রিকি পন্টিং তাকে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে পাঠিয়েছিল!

তবে হ্যাঁ, সিরিয়াসলি বললে, টেস্টেও বাংলাদেশ এখন দেশের মাটিতে যথেষ্ট শক্তিশালী দল। মূলত স্পিন বোলিং ও স্মার্ট ব্যাটিং দিয়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবসময়ই যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে দেশের বাইরেও সমীহ জাগানিয়া শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। আমার মনে হয় সেটা তারা করতে শুরু করেছে।

এই বিশ্বকাপ থেকেও সেটার একটা শুরু হতে পারে। শ্রীলঙ্কা যেমন ১৯৯৬ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো আমাদের হারিয়ে, সেটি ছিল বড় ক্রিকেট শক্তি হিসেবে তাদের আবির্ভাব। বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দারুণ করছে ওয়ানডেতে। শ্রীলঙ্কার মতো এবার যদি ওরা চ্যাম্পিয়ন হতে নাও পারে, অন্তত অনেক বছর পর পেছন ফিরে তাকিয়ে হয়ত দেখবে, এই টুর্নামেন্ট থেকেই ওদের বড় হওয়ার শুরু, বড় দলগুলিকে দেশের বাইরে নিয়মিত হারানোর শুরু। এবং সেটি শুধু স্পিন দিয়ে নয়, স্পিন-পেস মিলিয়ে। ব্যাটিং তো দুর্দান্ত মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশের উন্নতির কথা যখন বলছেন, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট মহলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের সময়ও কি এসেছে? ২০০৩ সালের পর বাংলাদেশকে টেস্ট সফরে নেয়নি অস্ট্রেলিয়া, ওয়ানডেতেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজে সবশেষ সফর ছিল ১০ বছর আগে...

ফ্লেমিং: শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশেরই পরস্পরের সঙ্গে খেলা উচিত। সফর, ফিরতি সফর নিয়মিত হওয়া উচিত।

বাংলাদেশের সফরে না ডাকার একটা কারণ হতে পারে, অস্ট্রেলিয়ার আসলে শঙ্কা আছে! কারণ বাংলাদেশকে সফরে নিলে ক্রিকেট মৌসুমে তো আর নেবে না, পরে নেবে। খেলতে হবে কেয়ার্নস বা ডারউইনে, যেখানে বল টার্ন করে। হয়তো তারা একটু হলেও শঙ্কিত যে দেশের মাটিতে বাংলাদেশের কাছে হারতে পারে!

বাংলাদেশ ও অন্যান্য উঠতি দলগুলিকে অবশ্যই বড় বড় দেশে, ভালো ভালো ভেন্যুতে খেলার সুযোগ দেওয়া উচিত। দিন-রাতের টেস্টে খেলার আমন্ত্রণ জানাতে পারে! অ্যাডিলেইডে এখন যেমন প্রতি বছরই দিন-রাতের টেস্ট হচ্ছে। সেখানে খেললে, পার্থের বাউন্সি উইকেটে খেললে, মেলবোর্নে খেললে অনেক কিছু শিখবে।

দর্শকের ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। আমার মনে আছে, ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ম্যাচ ছিল এমসিজিতে (মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড), প্রচুর দর্শক ছিল।

এই বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান সংগোহকারী একজন বাংলাদেশি, এটাও তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন!

ফ্লেমিং: সাকিবের পারফরম্যান্সে আমি মুগ্ধ। অবাক যদিও হইনি। গত ১০ বছর ধরেই সে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। আমরা যারা গভীরভাবে ক্রিকেট অনুসরণ করি, তারা সব সময়ই জানতাম, বাংলাদেশকে দারুণ কিছু করতে হলে সাকিবকে ভালো করতে হতোই।

আমার আগেও মনে হয়েছে, মিডল অর্ডারই কি সাকিবের উপযুক্ত জায়গা? টপ অর্ডারে কেন নয়! বিশ্বকাপে দেখলাম সেটিই করা হয়েছে। বিশ্বকাপে পিঠাপিঠি দুটি সেঞ্চুরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। আশা করি, সে এই ফর্ম ধরে রাখবে।

আমার যেটা ভালো লেগেছে, সাকিব সব সময়ই সম্ভাব্য গ্রেটদের কাতারে ছিল। প্রয়োজন ছিল স্রেফ সেটি নিশ্চিত করা। অন্য একটি পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে যাওয়া। আমি খুবই খুশি যে এই বিশ্বকপে নিজেকে সে নিজেকে সেই পর্যায়ে নিতে পেরেছে। অনেক বড় দায়িত্ব ছিল তার ওপর, কী দারুণভাবেই না পূরণ করছে!

বাংলাদেশের এই দল অনেক অভিজ্ঞ। মুর্তজা দারুণ এক অধিনায়ক, দলকে দেখে মনে হয় তারা অধিনায়কের জন্য খেলে। অবশ্যই মুর্তজার বয়স কমছে না, তবে এই টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্ব বেশ নজর কেড়েছে।

আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ যেভাবে খেলেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ একের পর এক বাউন্সার করেচে, শর্ট বল করেছে, বাংলাদেশ পাল্টা জবাব দিয়েছে। তার মানে, এসবে তারা আর ভীত নয়।

বাংলাদেশ দলে আমার সবচেয়ে প্রিয় ক্রিকেটার যদিও আরেকজন, দা ফিজ! মুস্তাফিজ সত্যিই বেশ ভালো। অবশ্যই সে খুব বেশি সুইং করাতে পারে না এখনও। আমার মতে, প্রথম পরিবর্ত বোলার হিসেবেই যে বেশি কার্যকর হতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেও তার বড় ভূমিকা থাকতে পারে। বিশেষ করে, স্লগ ওভারে। শেষের দিকে বাংলাদেশের সেরা বোলার ফিজ। শেষ ১০ ওভারে যে কোনো দলের জন্যই সে হতে পারে সম্পদ।

বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন ভালো কিছু ফাস্ট বোলার। একজন-দুজন ভালো পেসার তারা অনেক সময়ই পেয়েছে। প্রয়োজন আরও কয়েকজনকে পাওয়া। বুমরাহ-শামিদের মতো পেসার পাওয়া। কাজটা যদিও সহজ নয়।

আপনার খেলোয়াড়ী জীবনে বাংলাদেশ নিয়ে কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

ফ্লেমিং: বাংলাদেশের বিপক্ষে সম্ভবত একটি ম্যাচই আমি খেলেছি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে। বাংলাদেশের সেটি ছিল প্রথম বিশ্বকাপ, ওদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিল। আমাদের জন্যও ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে। প্রথম তিন ম্যাচের দুটি হেরেছিলাম আমরা। বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়টা প্রত্যাশিতই ছিল। আমরা রান রেটও বাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলাম। এজন্যই টম মুডিকে ওপরে ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়েছিল। ঝড়ো একটি ফিফটি করেছিল সে (২৯ বলে ৫৬*)। ম্যাচটা মনে আছে, কারণ বিশ্বকাপ জয়ের পথে আমাদের মূল যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ম্যাচ থেকেই।

শেষ প্রশ্ন সেই রান আউট নিয়ে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল, শেষ ওভারে বোলিংয়ে আপনি, টানা দুটি বাউন্ডারির পর ক্লুজনার-ডোনাল্ডের সেই পাগলাটে দৌড়, কতটা মনে পড়ে?

ফ্লেমিং: বিশ্বাসই হচ্ছে না, সেই ম্যাচের ২০ বছর হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন! আমার মনে হয়, সেই ওভারআর্ম ডেলিভারিটি দারুণ ছিল! রান আউটের ডেলিভারি! ল্যান্স ক্লুজনারকে করা আন্ডারআর্ম ডেলিভারিটি খারাপ ছিল না।

তবে, আন্ডারআর্ম ডেলিভারিটি আরও ভালো ছিল! গ্রেগ চ্যাপেলের সেই আন্ডারআর্মের চেয়ে ভালো কোনো আন্ডারআর্ম হয়েছিল, এটা খারাপ নয়! তবে সেই ম্যাচ, সেই বিশ্বকাপ অসাধারণ ছিল আমাদের জন্য।