ব্যাটসম্যান সাকিবকে দেখে নিক বিশ্ব

অলরাউন্ডার হিসেবে অসাধারণ। সবসময়ের সেরাদের একজন। বোলার হিসেবে দুর্দান্ত, বিশ্বস্ত, ধারাবাহিক। ব্যাটসম্যান সাকিব আল হাসান? তুলনা যখন বিশ্বসেরাদের সঙ্গে, ব্যাটসম্যান সাকিবকে নিয়ে ছিল দ্বিধা, ছিল সংশয়। এবারের বিশ্বকাপ যেন সাকিবের জন্য সেই দ্বিধা উড়িয়ে, যাবতীয় সংশয় গুঁড়িয়ে, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিকে এক বিন্দুতে মেলানোর মঞ্চ।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিটনটন থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 June 2019, 04:41 AM
Updated : 18 June 2019, 12:01 PM

প্রাথমিক পর্বে ৪৫ ম্যাচের ২৩টি যখন শেষ হলো, রান স্কোরারদের শীর্ষে জ্বলজ্বল করছে সাকিবের নাম। এক বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের রেকর্ড ৩৮৪ রান করে ফেলেছেন ৪ ইনিংস খেলেই। গড় ১২৮, স্ট্রাইক রেট ১০৩.৭৮। সাকিবের ব্যাট বলছে, আমাকে চিনে নাও বিশ্ব!

এমনিতে নিজের পরিচয় বছরের পর বছর পারফরম্যান্সেই মেলে ধরেছেন সাকিব। গত ১০ বছর ধরেই তিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। পারফরম্যান্স আর ধারাবাহিকতা সেটির প্রমাণ, র‌্যাঙ্কিং সেটির প্রতিবিম্ব। বাঁহাতি স্পিনেও বিশ্বসেরাদের একজন এক দশক ধরে। ব্যাটিংয়ে ছিলেন বাংলাদেশের সফলতমদের একজন। কেবল বিশ্বমানটা নিশ্চিত করার ছিল বিশ্বমঞ্চে।

সেই সামর্থ্য তার বরাবরই ছিল। নানা সময়ে ঝলক দেখিয়েছেনও। বাংলাদেশের মানে যথেষ্ট ধারাবাহিকও ছিলেন। কিন্তু বিশ্বসেরাদের কাতারে যেতে হলে যে মানদণ্ড বাঁধা আরও উঁচুতে! সেটিই ছোঁয়া হয়ে উঠছিল না। দীর্ঘদিন পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেছেন, এটা একটি কারণ। অনেক অনেক ম্যাচে ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে না পারা কিংবা খেলা শেষ করে আসতে না পারা একটি কারণ। হয়তো কখনও কখনও নিজের ভেতর সেই ক্ষুধা বা তাড়না অনুভব করতে না পারা ছিল একটি কারণ।

গত আইপিএল থেকে যখন ওজন কমিয়ে, আরও ঝরঝরে হয়ে ফিরলেন, কিছু একটার আভাস মিলছিল। সেটা টের পাওয়া গেলে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের সময়। নিজেই জানালেন, কিছু একটা করার তাড়না থেকেই বিশ্বকাপের আগে শাণিত করছেন নিজেকে। ফিটনেস নিয়ে খেটে ওজন কমিয়ে প্রায় সেই ১০ বছর আগের চেহারায় ফিরে যাওয়া, ব্যাটিং-বোলিং নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করা, এই বিশ্বকাপের জন্য সম্ভবত জীবনের সেরা প্রস্তুতি নিয়েছেন সাকিব। ব্যাটসম্যান সাকিবের সেরা সময়টা সেটিরই উপহার।

সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরছে ওপরের পরিসংখ্যানই। আগের কোনো বিশ্বকাপেই নিজের মানে খেলতে পারেননি। এবার বাংলাদেশের রেকর্ড করে ছুটছেন আরও বড় কিছুর পথে। বিশ্বকাপের চার ম্যাচ আর এর আগে আয়ারল্যান্ড সিরিজ নিয়ে টানা পাঁচ ইনিংসে খেললেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস, তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবার!

তবে শুধু পরিসংখ্যান নয়, ব্যাটসম্যান সাকিবের নতুন দিনের জয়গান গাইছে তার ব্যাটিংয়ের ধরন। উইকেটে তার আত্মবিশ্বাসী পদচারণা। লম্বা ইনিংস খেলার প্রবণতা। তুষ্ট না হয়ে কষ্ট করে যাওয়া।

ফিটনেসে উন্নতির সরাসরি প্রভাব ব্যাটিংয়ে দেখা যাচ্ছে হরহামেশাই। ব্যাটকে চাবুকের মতো চালিয়ে যে পুল বা কাট শটে রান করছেন প্রচুর, সেটিই হয়তো আগে উঠে যেত আকাশে কিংবা নিত ব্যাটের কানা। বড় শট ধারাবাহিকভাবে খেলার সামর্থ্য বেড়েছে। সিঙ্গেল-ডাবলস নেওয়ায় বরাবরই তার জুড়ি মেলা ভার। এখন সেটির হার বেড়েছে আরও। হয়েছেন আরও ক্ষিপ্র।

ব্যাটিংয়ে তিনি দাপট ও কর্তৃত্বের ছাপ রাখতে চাইতেন বরাবরই। কিন্তু সেই চাওয়া ধারাবাহিকতার রূপ পায়নি আগে। ফিটনেসে উন্নতির পর সাকিব যেভাবে ব্যাট করে চলেছেন, তাতে পরিষ্কার ঘোষণা, নিজের খেলাটা তিনি আগের চেয়ে ভালো জানেন। আগের চেয়ে বেশি উপভোগ করছেন। যেন কোনো রাজা বিচরণ করছেন নিজের রাজত্বে!

সবচেয়ে বড় কথা, তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ের জন্য নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন দরকার, সাকিবের ব্যাট সেই দাবি মিটাতে শুরু করেছে নিয়মিতই। এক পাশ আগলে রাখছেন, দ্রুত রান তুলছেন, লম্বা ইনিংস খেলছেন, বড় জুটি গড়ছেন, ঝুঁকি না নিয়েই রান তুলছেন। অতীতে অনেকবারই কাজ শেষ করে আসতে পারেননি বলে আক্ষেপ করেছেন। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকে দলের জয় সঙ্গে নিয়ে ফেরাকেও অভ্যাস বানিয়ে ফেলছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৯ বলে অপরাজিত ১২৪ সেটিরই ধারাবাহিকতা।

আগে তিনটি বিশ্বকাপ খেলেও রাঙাতে পারেননি সেভাবে, কোনো একটি আসর অন্তত নিজের করে নিতে পারেননি, অসাধারণ পারফরফ্যান্সে বানাতে পারেননি ক্যারিয়ারের অন্যতম ‘হাইলাইট’, তার মাপের একজনের জন্য বড্ড বেমানান। এবার তাই সব মানিয়ে দিচ্ছেন।

অলরাউন্ডার সাকিবের শ্রেষ্ঠত্বের যেমন খোদাই হচ্ছে আরও গভীরভাবে, ব্যাটসম্যান সাকিবও রোজ পাখা মেলছেন নতুন দিগন্তে। হয়ত ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেও নিজেকে চিনছেন নতুনভাবে। সামর্থ্যের সীমানা যখন বাড়ছে রোজ, বিশ্বকাপকে দেখানোর বাকি আছে আরও অনেক।