বিশ্বাসের শক্তিতে এগিয়ে চলার জয়

“বিশ্বাস অবশ্যই আছে...আমি বিশ্বাস করি, আমার দল বিশ্বাস করে”, ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। নিজের বিশ্বাস দলে ছড়িয়ে দেওয়া কিংবা দলের বিশ্বাসে নিজে একাত্ম হওয়া। অপেক্ষা ছিল সেই কথার সুরে ২২ গজে মেতে ওঠার। সেই ছন্দের দোলায় ঠিকই মাতল বাংলাদেশ। বিশ্বাসটা হৃদয় গভীরে ছিল বলেই পারফরম্যান্স হলো এমন হৃদয় খোলা।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিটনটন থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2019, 11:53 PM
Updated : 17 June 2019, 11:53 PM

একটা কথা মনে রাখা দরকার, র‌্যাঙ্কিং ও মুখোমুখি লড়াইয়ের সাম্প্রতিক চিত্র মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচকে আবশ্যিক জয়ের তালিকায় অনেক আগে থেকেই রেখেছিল বাংলাদেশ। জয়টা খুবই প্রত্যাশিত ছিল। তবে প্রত্যাশিত ছিল না পরিস্থিতি। পক্ষে ছিল না বাস্তবতা। বাংলাদেশের জয়টা বিশেষ কিছু এই দুটি কারণেই।

কেমন ছিল পরিস্থিতি? জয়ে শুরুর পর টানা দুই ম্যাচে হার, এরপর শ্রীলঙ্কা ম্যাচে বৃষ্টিতে পয়েন্ট হারানো। সামনের ছবিটা তাই অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল একটু। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা না হওয়াকে দল দেখেছে সম্ভাব্য দুই পয়েন্টের একটি হারানো হিসেবে। নিউ জিল্যান্ডকে বাগে পেয়েও হারাতে না পারার যন্ত্রণা তাতে তীব্র হয় আরও।

কি ছিল বাস্তবতা? প্রচণ্ড চাপ। ম্যাচের আগের চাপ, এই ম্যাচে হারলে বিশ্বকাপ স্বপ্নের দুয়ার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া। ম্যাচের মাঝামাঝি চাপ, নিজেদের ৩৩ বছরের ওয়ানডে ইতিহাসে কখনও যে উচ্চতা ছোঁয়া হয়নি, সেটি স্পর্শ করার। ৩২০ রানের বেশি তাড়ার পথ কখনও পায়নি বাংলাদেশ, অজানা ছিল সেই স্বাদ।

বিশ্বাসের মন্ত্রে সব জয় করে নিল দল। এই শক্তি আরও পোক্ত হবে এবার। দলের কারও বিশ্বাসে যদি ঘুনপোকার অস্তিত্ব থাকত, নিজেদের নিয়ে থাকত সামান্যতম সংশয়, সব পিষে যাওয়ার কথা ক্যারিবিয়ানদের পিষ্ট করে পাওয়া জয়ে।

দলের তাড়নার প্রতিফলন ম্যাচের শুরু থেকেই। ম্যাচের প্রথম ওভারেই ক্রিস গেইলকে ভুগিয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজা আদায় করে নিলেন মেডেন। নিজের প্রথম ৫ ওভারে অধিনায়ক ছিলেন প্রায় নিখুঁত। গেইল, এভিন লুইসদের পরাস্ত করলেন বারবার। কখনও অল্পের জন্য ব্যাটের কানা নিল না বল। কখনও ব্যাটের কানা নিয়ে অল্পের জন্য লাগল না স্টাম্পে।

মাশরাফির অমন শুরু ছিল দিনের দাবি। টসের সময় দুই অধিনায়কেরই চাওয়া ছিল আগে বোলিং। মাশরাফি টসভাগ্যে জিতে বললেন, কাজে লাগাতে চান শুরুর আর্দ্রতা। পথ দেখাতে হতো তাকেই। তা দেখালেন বটে! দুই পায়ের হ্যামস্ট্রিংয়ে টান ভুগিয়ে চলেছে। সেসবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই ফিরলেন সেরার প্রায় কাছে।

উইকেট এসেছে আরেকপাশ থেকে। গেইলকে সামনে টেনে এনে লেংথ থেকে কাটব্যাক করা যে ডেলিভারিতে উইকেট নিলেন সাইফ উদ্দিন, সেটি আউট করতে পারত যে কোনো বাঁহাতিকে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ শুরুতে ছুটতে পারেনি গতিময়তায়, শেষের স্কোর আরও বড় না হওয়ায় বড় অবদান প্রথম ১০ ওভারের কেবল ওই ৩২ রান হওয়ায়।

সাকিব আল হাসানের চাতুর্য ফিরিয়েছে জমে বসা লুইসকে, ভালোভাবে জমে ওঠার আগেই থামিয়েছে নিকোলাস পুরানকে।

কিন্তু এই ম্যাচে ব্যাটিং শক্তি বাড়ানো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট হাতে হাল ছেড়ে দেবে, এটাও তো বেশি চাওয়া! তাই ঝড় উঠেছে, রানের গতি বেড়েছে। শিমরন হেটমায়ারের তাণ্ডবে চার ওভারেই যোগ হয়ে গেছে ৬০ রান। শঙ্কার মেঘ জমেছে।

তবে ওই যে, দলের মন্ত্রই বিশ্বাসের! ৫ ওভারে ৪১ রান দেওয়া মুস্তাফিজুর রহমানের ওপর তাই আবার ভরসা রাখেন অধিনায়ক। তাকিয়ে থাকে দল। এক ওভারে দুই উইকেট নিয়ে তিনিই আশায় দম দেন নতুন করে। বড় বাধা হয়ে থাকা শেই হোপকেও ফিরিয়ে হয়ে যান সফলতম বোলার।

মাশরাফি আর সাইফ, সাকিব থেকে মুস্তাফিজ, এই ছোট ছোট ছবিগুলোই জোড়া লেগে দাঁড়িয়েছে ম্যাচের বৃহত্তর ছবি। যদিও আগে কখনও এত বড় রান তাড়ার নজীর নেই, তবু ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দলকে ছোট মাঠে এবং সেই ৪ ওভারে ৬০ রানের পরও ৩২১ রানে আটকে রাখা খুব খারাপ বোলিং পারফরম্যান্স নয়।

সেটিই পরে আরও প্রমাণ করে দিল ব্যাটসম্যানরা। রান তাড়ার বিশ্বাসের বাতি জ্বালিয়ে দিলেন সৌম্য সরকার। ক্রমেই সেই আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে প্রতিফলিত হলো অন্যদের ব্যাটে। রান আউটে নেভার আগে তামিম ইকবালও জ্বলে উঠলেন আপন চেহারায়। সাকিব ও লিটনের আলোর ছটায় ধাঁধিয়ে গেল চারপাশ। রোশনাই ছড়িয়ে গেল দূর-দূরান্তে। আলোকোজ্জ্বল জয়ে উদ্ভাসিত হলো দল।

বিশ্বমঞ্চে নিজেকে নতুনভাবে চেনানোর যে মিশনে নেমেছেন সাকিব, সেটিই সাফল্যের পথে আরও দ্রুত ছুটিয়ে দিল এই সেঞ্চুরি। তার ব্যাটসম্যানশিপের বড় একটি বার্তাও ঘোষিত হলো যেন। লিটন মেলে ধরলেন নিজের ঝলমলে বিজ্ঞাপন।

তিনশর বেশি রান তাড়ায় এমন দাপুটে জয়, একসময় কেবল স্বপ্নই দেখতো দল। এখন স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় পেয়েও আবেগের জোয়ার বয় না। উদযাপনে বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস থাকে না, জয় এনে দেওয়া শটের পর কেউ ছুটে মাঠে ঢোকে না, হোটেলে ফিরে থাকে না কোনো আয়োজন। এমনটিই যেন স্বাভাবিক!

সব মিলিয়ে নিত্য নতুন সীমানায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের পা রাখার আরেকটি উদাহরণ দেখিয়ে দিল এই ম্যাচ। সাকিব যেমন ম্যাচ শেষে বললেন, “বড় দলগুলির মতো পুরোদস্তুর ক্রিকেট শট খেলেই সম্ভব হয়েছে এমন রান তাড়া। অবশ্যই বাংলাদেশ উঠেছে নতুন লেভেলে।”

‘লেভেল’ পেরিয়ে নতুন উচ্চতায় পা রাখার এই ধারা চলতেই থাকবে। প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতা অনেক, তবু বাংলাদেশ বিশ্বাস করে!