স্পেশাল সাকিব, স্পেশাল বাংলাদেশ

ম্যাচের শেষ বলটা হতেই যখন নানা প্রান্ত থেকে মাঠের মাঝে ছুটে আসছেন সবাই, মাশরাফি বিন মুর্তজা ছুটলেন সাকিব আল হাসানের কাছে। আলিঙ্গনে জড়ালেন ডেপুটিকে। আঁকড়ে রাখলেন শক্ত করে। যেন মাখিয়ে দিলেন ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস আর নির্ভরতার পরশ। বাংলাদেশ অধিনায়ক তো জানেন, বিশেষ মানুষটির বিশেষ পারফরম্যান্সেই এসেছে বিশেষ জয়!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিলন্ডন থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2019, 08:56 AM
Updated : 3 June 2019, 08:56 AM

কতটা বিশেষ পারফরম্যান্স? ওই মাশরাফি যখন বোলিংয়ে মার খাচ্ছিলেন, ছুটে এলেন সাকিব। পিঠ চাপড়ে দিলেন, কত কী যে বললেন। একবার নয়, বেশ কবার। মুস্তাফিজুর রহমান একটি আলগা বল করলেন। সাকিব ছুটে এলেন। বোঝালেন নানা কিছু। মূল স্ট্রাইক বোলারের ফোকাস ধরে রাখতে হবে তো! পয়েন্টে দারুণ ফিল্ডিং করলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। মিড অফ থেকে ছুটলেন সাকিব। ছেলেটাকে উৎসাহ দিতে হবে তো!

বল ছুটলে বাউন্ডারির দিকে। সাকিব ছুটছেন পিছু পিছু। প্রবল চেষ্টায়ও শেষ পর্যন্ত পারলেন না চার ঠেকাতে। নিজের ওপর কী যে বিরক্ত! ম্যাচ জুড়ে চিৎকার করে গেলেন। মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ালেন। বোলিং পরিবর্তন, ফিল্ডিং সাজানোয় অধিনায়ককে সাহায্য করে গেলেন। ওকে ডাকা, তাকে সরানো। কখনও কণ্ঠে, কখনও শরীরী ভাষায় প্রাণবন্ত থাকলেন প্রতিটি মূহুর্ত। সম্পৃক্ত থাকলেন সবটুকু। একেকটি উইকেটে মেতে উঠলেন আনন্দে। চাপে ধরে রাখলেন নিজেকে। প্রয়োজনে উজার করে দিলেন সবটা।

৭৫ রান, ১ উইকেট আর ১টি দারুণ ক্যাচ। ম্যান অব দা ম্যাচ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের সাধ্য কী, রোববার ওভালের সাকিবকে পুরো ফুটিয়ে তোলার! 

এমনিতেই দিনটি সাকিবের জন্য ছিল প্রাপ্তিতে প্রায় টইটম্বুর। তিন অঙ্ক ছুঁতে পারলে ওই ‘প্রায়’ শব্দটিও বসাতে হতো না। তবে সেঞ্চুরি না হলেও ৭৫ রানের ইনিংসটি মিটিয়েছে সময়ের দাবি। গড়েছেন টানা চারটি বিশ্বকাপে দলের প্রথম ম্যাচে ফিফটির তাক লাগানো কীর্তি। মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে রেকর্ড ১৪২ রানের জুটি দলকে জুগিয়েছে বড় স্কোরের জ্বালানি। দুর্দান্ত ডেলিভারিতে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। সেই উইকেট তাকে এনে দিয়েছে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে ২৫০ উইকেট ও ৫ হাজার রানের ডাবল অর্জনের কৃতিত্ব।

আঁটসাঁট বোলিংয়ে টেনে ধরেছেন রানের রাশ। লাইন-লেংথ, গতি বৈচিত্র ছিল দারুণ। ১০ ওভারের স্পেলে বাউন্ডারি হজম করেছেন মোটে দুটি।

এসব অবশ্য প্রত্যাশিতই। বাংলাদেশের সব সময়ের সেরা ক্রিকেটার তিনি তর্কাতীতভাবে হয়ে গেছেন আরও কয়েক বছর আগেই। গত ১০ বছরের ধারাবাহিকতায় বিশ্ব ক্রিকেটে তার ধারেকাছে নেই আর কোনো অলরাউন্ডার। ক্রিকেট কুলীন জগতের অনেকে তার শ্রেষ্ঠত্বকে সংশয় বা অবহেলা করতে চাইলেও দিনের পর দিন পারফরম্যান্স দিয়েই তিনি সব যুগের সেরা অলরাউন্ডারদের টপকে যাচ্ছেন বা জায়গা করে নিচ্ছেন পাশে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ব্যাট-বলের পারফরম্যান্স তাই বিস্ময় জাগায় না।

তবু এই ম্যাচের সাকিব স্পেশাল, কারণ তিনি আবদ্ধ ছিলেন না কেবল ব্যাট-বলের ২২ গজে। এ দিনের সাকিব ছিলেন মাঠের সবটায়। ছিলেন উদ্দীপ্ত, ছিলেন উজ্জীবিত। ছিলেন ম্যাচের প্রতিটি ক্ষণে, লড়েছেন প্রাণপণে। এই ম্যাচের জয় সাকিবময় জয়। দলের সেরা ক্রিকেটার যখন এভাবে ছড়িয়ে ও জড়িয়ে থাকেন ম্যাচের প্রতিটি খুঁটিনাটিতে, সেই দলকে হারানো কঠিন।

ম্যাচ শেষের বেশ অনেকটা পর, মাঠ ছেড়ে যাওয়ার আগে যখন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হলেন সাকিব, চোখ-মুখে লেপ্টে ছিল যেন তৃপ্তির দীপ্তি। কণ্ঠ থেকেও ফুটল যেন সেই আলোর ছটা।

“হ্যাঁ, অবশ্যই স্পেশাল। নিজের কথা চিন্তা করলে দিনটি অবশ্যই খুব ভালো ছিল। দলের জয়ে অবদান রাখতে পেরেছি, নিজের কিছু মাইলফলক হয়েছে। তবে শুধু আমার নয়, বাংলাদেশ দলের জন্যও স্পেশাল দিন। বিশ্বকাপের মতো জায়গায় কঠিন চ্যালেঞ্জে ভালোভাবে শুরু করাটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেদিক থেকে বিশেষ দিন।”

এক যুগের বেশি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সম্ভবত তার প্রতিটি ব্যক্তিগত অর্জনের ক্ষেত্রেই তিনি সবচেয়ে বেশি বলেছেন, দলে অবদান রাখার কথা। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে আইপিএলের সময় তার ফিটনেস ট্রেনিং, ওজন কমিয়ে সেই বিশ বছর বয়সের চেহারায় ফিরে যাওয়া, এসব নিয়ে হইচই, কৌতূহলের ঝড় কম ওঠেনি। একটা ‘কিক’ থেকেই ফিটনেস ঠিক পথে এসেছে, বলেছেন কদিন আগে; কোন ‘কিক’ সেটি নিয়ে যদিও কৌতূহলই রেখে দিয়েছেন। তবে ইঙ্গিতটা মিলছে। হতে যাচ্ছে ভালো কিছু। বড় কিছু। দারুণ কিছু!

প্রথম ম্যাচেই বার্তাটি দিয়ে রাখলেন বাংলাদেশের ‘সুপারম্যান’। বিশ্বসেরার বিশ্বকাপ মাতানো কেবল শুরু!